
প্রায় ৩৫ বছর পূর্বে বেঁদে সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে এসে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সীরহাট নামক স্থানে (কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে) নৌকা বেঁধে যাযাবর জীবন যাপন শুরু করে। তাদের মধ্য থেকে পুরুষরা এলাকায় ঘুরে ঘুরে সাপ ধরা, পাখি মারা, হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণ-রোপ্যের গহনা খুঁজে বের করা ও হাটে-বাজারে তাবিজ কবজ বিক্রি করার কাজ শুরু করে। মহিলারা সাপ খেলা দেখানো, সিঙ্গা লাগিয়ে বিভিন্ন রোগ সারানো, দাঁতের পোকা ফেলানো ইত্যাদি চিকিৎসা করার কাজ করতেন। এভাবেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হত।
অনেক পুরুষ নিজ সম্প্রদায়ের কম বয়সী একাধিক মেয়েদের বিয়ে করে ঘর পাহাড়া দিতেন। তাদের স্ত্রীরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যাযাবর জীবনযাপন ছিল তাদের। তারা সরকারের বা স্থানীয় কোন আইন-কানুন বা নিয়ম-রীতি মানতেন না। সেই চিন্তা ধারা থেকে তাদের উত্তোরণ ঘটতে শুরু করেছে। বর্তমানে যাযাবর জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়ে স্থায়ী বসতি গড়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করেছেন তারা। এখন তারা স্থানীয় সরকারের সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলছেন। ভোগ করছেন নাগরিক সুযোগ সুবিধাও। এ বছর বেঁদে সম্প্রদায়ের ১২০ পরিবারের ৫ শতাধিক জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ভোটার হয়েছে। এদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল, কলেজ, মক্তব ও মাদরাসায় লেখাপড়া করা শুরু করেছেন।
ইতোমধ্যে অনেকেই তাদের পুরানো পেশা ছেড়ে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য (মাছ বিক্রি, কাপড়-চোপড় বিক্রি, ক্রোকারিজ বিক্রিসহ বিভিন্ন মালামাল ফেরি করে বিক্রি)’র কাজ করছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এদের ছেলে-মেয়েদের স্বজাতির বাহিরে বিয়ে দিয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে তুলছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কেও এদের মধ্যে অনেক পরিবার সচেতন হয়েছে।
সরেজমির গিয়ে দেখা যায়, যারা নৌকায় জীবন যাপন করতেন এবং পুকুর-ডোবা থেকে স্বর্ণ-রৌপ্য গহনা তুলতেন, তাবিজ-কবজ বিক্রি করাসহ বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা ডোমসার গ্রামের কীর্তিনাশা নদীর তীর ঘেঁষে নিজেরা জমি ক্রয় করে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে। বেঁদের সর্দার আব্দুল ছাত্তারের অধীনে ১২০টি পরিবারের স্থায়ী বসবাস স্থল গড়ে উঠেছে। এখনও তাদের সাম্প্রদায়িক ঐক্য অটুট রয়েছে। সর্দারকে এখনও বেঁদে সম্প্রদায়ের সবাই মেনে চলে। অবসর সময় পুরুষেরা তাস খেলে ও নারীরা লুডু খেলে সময় কাটায়।
বেঁদে সর্দার আব্দুল ছাত্তার বলেন, সাপ খেলা, ঝাড়-ফুক তাবিজ-কবজ বিক্রির ব্যবসা এখন মন্দা। এগুলোর প্রতি মানুষ আর আগের মতো আকৃষ্ট হয় না। জীবন-জীবিকাও ভালো চলছেনা তাই কেউ কেউ বিকল্প পেশার জড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, বেঁদে পরিবার গুলোতে প্রায় আড়াই শতাধিক ভোটার রয়েছে। নির্বাচনের সময় তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে। এ বছর ভোটার হালনাগাদের সময় আরও অনেকেই ভোটার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তারা নাগরিক সুবিধাও পেয়ে থাকেন।
শিশু কিশোরদের মধ্য থেকে আলাপ হয় অমিত হোসেন, জাহিতুল ইসলাম সহ অনেকের সাথে। তারা জানায়, ডোমসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে তারা পড়াশুনা করছে। তাদের বসতির নিকটবর্তী কোন বিদ্যালয় থাকলে তাদের পড়াশুনার জন্য ভালো হতো। নদী পাড় হয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। তাহলে সেই সমস্যা সমাধান হতো।
যুবক আরিফ হোসেন বলেন, বাব-চাচারা যখন নৌকায় চরে যাযাবর জীবন যাপন করতেন তখন আমরা লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। ডোমসারের স্থানীয় বাসিন্দা হয়ে আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমার এক ভাই আনসারে চাকরি করছেন। শিক্ষার অভাবে আমাদের সমাজ পিছিয়ে আছে। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের পড়াশুনা শিখিয়ে শিক্ষিত করে সমাজের সঙ্গে মিল রাখে চলব। আল-আমিন বলেন, মানুষের স্বর্ণ-রৌপ্যর গহনা পানিতে পড়ে হাড়িয়ে গেলে তা তুলে দেই। এ কাজ অনেক পরিশ্রমের। তাই সন্তাানদের এ কাজ করতে দেব না। লেখাপড়া করাবো।
সাপুরে আফসার সরদার বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাজ হিসেবে সাপ খেলা দেখাই। আমার কাছে বিভিন্ন ধরনের সাপ আছে। সাপ গুলোকে দুধ, ব্যাঙ, মাছ, মুরগি ও কবুতরের বাচ্চা খাওয়াতে হয়। তাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সেই হিসেবে খেলা দেখিয়ে আয় হচ্ছে না। স্ত্রী সন্তাান নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। ভাবছি এ পেশা ছেড়ে দেব।
ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. চাঁন মিয়া মাদবর বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। মেম্বারের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা সহ সকল নাগরিক সুবিধা তাদের দেয়া হচ্ছে। তাদের ছেলে মেয়েরা যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে আমরা সব খোঁজ খবর রাখছি। নদী পাড় হয়ে যেন শিক্ষার্থীরা খুব সহজে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যেতে পারে তার জন্য তাদের নৌকার ব্যবস্থা করছেন জেলা প্রশাসক। বেদেরা তাদের মূল পেশা ছেড়ে লেখাপড়া করে বিকল্প পেশার সন্ধানে ছুটছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান শেখ বলেন, বেদে সম্প্রদায়দের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। তাদের স্থায়ী করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রর ব্যবস্থা করেছেন। তাদের সন্তানদের শিক্ষা উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমাজ সেবার পক্ষ থেকে নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ ও পুরুষদের আইসিটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সাবলম্বি করতে বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে। তারা এখন যাযাবর নয়। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সকল নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে তারা।