
শরীয়তপুরের জাজিরার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার সদ্য বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিদর্শক (তদন্ত) সুরুজ উদ্দিন আহম্মেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ওই আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশটি সন্ধ্যায় শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পৌঁছায়।
মোস্তাফিজুর রহমানকে চট্টগ্রাম ও সুরুজ উদ্দিনকে বরিশাল রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তারা শরীয়তপুরে কর্মরত আছেন।
শরীয়তপুরের নাওডোবা এলাকার ব্যবসায়ী সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদার ও তাদের বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু চোকদারসহ তাদের স্বজনদেরকে একটি ছিনতাই মামলার ঘটনায় নির্যাতন করে ৭২ লাখ টাকার চেক নেওয়ার অভিযোগে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এরআগে ৭ জুন মোস্তাফিজুরকে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া একই ঘটনায় আগামী ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে পুলিশ সুপারকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক মোবাইল ফোনে বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের শরীয়তপুর থেকে অন্যত্র সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশ, ভুক্তভোগী ও অভিযোগ সূত্রে জানায়, গত ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদার কান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল,কে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেড় হন। জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান। ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০/১২ পুলিশ সদস্য।
অভিযোগে বলা হয়, এ সময় সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখালে তা ছিঁড়ে ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পরে পুলিশ সাদ্দাম ও বকুলকে লাথি, কিল-ঘুষি, চড় থাপ্পড়সহ পুলিশের লাঠি (ডান্ডা), কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। একপর্যায়ে প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। সাদ্দাম পানি পান করতে চাইলে ছোট ভাই বকুলকে দাঁড় করিয়ে মুখে প্রস্রাব করতে বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির। পরে সাদ্দামের শরীরে প্রস্রাব করেন বকুল। এমন নির্যাতন চলে রাত ১টা থেকে পরদিন ৩১ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত।
অভিযোগে জানা যায়, কিছুক্ষণ পর ওই চারজনকে গামছা ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে আনা হয়। পরে সাদ্দাম ও বকুল এবং সাইদুল ও আনোয়ারকে পৃথক দুই স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, ‘সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছি। তোরা ৭২ লাখ টাকা দিবি, তা না হলে তোদেরও ক্রসফায়ার দিয়ে দেওয়া হবে’। এভাবে সারাদিন রেখে রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় এনে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে বেত ও কাঠ, কোদালের বাট, লাঠি দিয়ে আবার বেধড়ক মারা হয় সাদ্দাম ও বকুলকে। সারারাত চলে এ নির্যাতন। এরপর টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী সানজিদা, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারারাত আটকে রাখা হয় এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
অভিযোগে জানা যায়, পরে আত্মীয়-স্বজনরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা দিলে নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে সাদ্দাম ও বকুলের। এ দুদিন যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও তাদের খাবার ও ঔষধ দেয়নি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসি।
অভিযোগকারীরা জানান, ১ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনকে শরীয়তপুর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রিমান্ড না মঞ্জুর করেন। ৬ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনই আদালত থেকে জামিন পায়।
এ নির্যাতনের ঘটনায় সাদ্দাম, বকুল ও তাদের বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেন।
ছিনতাই মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আলম শেখ (২০) ও সেকেন্দার মাদবরকে (৫১) জোরপূর্বক নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় স্থানীয় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ১০/১১ জন। ডলারসহ যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা ধরা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৩ মে শাহীন আলম শেখ বাদী হয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় সাদ্দাম, বকুলসহ নয়জনের নাম নিয়ে অজ্ঞাত পাঁচ/ছয়জনকে আসামি করে একটি ছিনতাই মামলা করেন। তবে শাহীন আলম শেখ ও সাদ্দাম চোকদারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শত্রুতা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।