
একটি মামলায় প্রতিবন্ধী ছেলের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত। তাই ছেলেকে বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অসহায় এক মা। এখন ওই মা নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে ছেলেকে বাঁচাতে সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কোথাও কোন সমাধান পাচ্ছেন না তিনি। তিনি এখন বলছেন, ‘আমি জমি চাইনা, ছেলেকে চাই’।
মামলা সুত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের কেচুয়ারচর গ্রামের মৃত ছমেদ সরদারের ছেলে প্রতিবন্ধী বাবুল সরদারের (৫০) বিরুদ্ধে একই গ্রামের ইউনুছ ঢালীর মেয়ে সুমি আক্তার ২০১২ সালের ৪ মে গোসাইরহাট থানায় একটি ধর্ষণ মাললা দায়ের করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল সন্ধ্যার পর বাবুলের কর্মচারী ফরহাদের সাথে বিয়ের কথা পাকাপাকি করার জন্য বাবুল সুমিকে ফোন করে তাদের বাড়ি যেতে বলেন। বাবুলের কথায় বিশ^াস করে সুমি বাবুলের বাড়িতে গিয়ে ফরদাহকে দেখতে পান এবং জানতে পারেন বাবুলের স্ত্রী বাড়ি নাই। আলাপ আলোচনা শেষে পরবর্তী শুক্রবার ফরহাদ ও সুমির বিয়ের দিন ধার্য করেন বাবুল। পরে বাবুল ইশারায় ফরহাদকে চলে যেতে বলেন। ফরহাদ চলে যাওয়ার পর বাবুল সুমিকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এ ঘটনার ১২ দিন পর সুমি বাবুলের বিরুদ্ধে গোসাইরহাট থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। মামলাটি দীর্ঘদিন শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকার পর গত ২ জুলাই আসামীর অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন আদালত। কিন্তু আসামীপক্ষ দাবি করেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে একটি সাজানো মিথ্যা মামলায় বাবুলকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। তাই বাবুলের মা মমতাজ বেগম ছেলেকে বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তিনি খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে ছেলেকে বাঁচাতে বিভিন্ন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সবার কাছে আকুতি করে বলছেন, ‘আমি জমি চাইনা, ছেলেকে চাই।’
বাবুলের মা মমতাজ বেগম বলেন, আমি বিধবা অসহায় একজন গরিব মানুষ। আমার জায়গা জমি দখল করার জন্য এলাকার কিছু লোক দীর্ঘদিন যাবত চেষ্টা করে আসছে। এলাকার কিছু লোকের সাথে আমাদের জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতা আছে। তারা আমাকে আমার জমি থেকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে আসছে। তারা আমাকে বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করতে দেয়না। আমার পুকুরে পাটের জাগ দিয়ে পুকুরের পানি নষ্ট দূর্গন্ধ করে ফেলেছে তারা। পঁচা পানির দূর্গন্ধে বাড়িতে থাকতে পারিনা। জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এই জায়গা জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে এবং জোরপূর্বক আমাদের সম্পত্তি ভোগ দখলের জন্য এলাকার একটি দুচ্চরিত্র মেয়েকে দিয়ে আমার ছেলের বিরুদ্ধে সাজানো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এলাকার সবাই জানে ওই মেয়ের চরিত্র ভালো না। তার একাধিক বিয়ে হয়েছে। ওই মেয়ে আমার ছেলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছে তার কোন ভিত্তি নেই। ওই ঘটনা এলাকার কেউ দেখেনি এবং জানেও না। মামলা করার পরে এলাকার মানুষ জানতে পেরেছে। সেই মামলায় আমার ছেলেকে সাজা দেওয়া হয়েছে। যেদিন সাজা দেওয়া হয়েছে সেদিন আমার ছেলে আদালতে হাজির হয়। কিন্তু পেশকার আমাদের চলে যেতে বললে আমরা চলে আসি। পরের দিন শুনি আমার ছেলের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।
মমতাজ বেগম বলেন, যে জমির কারণে আমার ছেলের বিরুদ্ধে সাজানো মিথ্যা মামলা ও সাজা দেওয়া হয়েছে আমি এখন সেই জমি চাইনা। আমি আমার সব জমি সরকারকে দান করে দিবো। তবুও আমি আমার ছেলেকে বাঁচাতে চাই, আমি আমার ছেলের মুক্তি চাই। আমি জমি চাই না, ছেলেকে চাই।
এ বিষয়ে জানার জন্য সরেজমিন গিয়ে স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে অনেকেই জানান তারা ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না। প্রতিবেশীরাও ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটছে কিনা তা বলতে পারেন না। অনেকেই বলেন, তারা শুনেছেন সুমি নামের একটি মেয়ে প্রতিবন্ধী বাবুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু এ ধরণের ঘটনা কেউ দেখেনি।
এ বিষয়ে প্রতিবেশী আবুল কালাম শিকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা আমার জানা নাই। শুনেছি বাবুলের বিরুদ্ধে একটি মেয়ে ধর্ষণ মামলা করেছে। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে আমরা কেউ দেখিও নাই, শুনিও নাই।
সালাম সরদার বলেন, শুনেছি বাবুলের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষন মামলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরণের কোন ঘটনা আমরা কেউ দেখি নাই। এ বিষয়ে কেউ দরবার সালিশ করেছে কিনা তাও শুনি নাই।
আব্দুল গণি বিশ^াস বলেন, বাবুল একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। স্বাধীনের সময় তার পা পুড়ে পঙ্গু হয়ে যায়। বাবুল এ ধরণের কাজ করতে পারে বলে আমি বিশ^াস করি না। আর এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটলে এলাকার সবাই জানতো এবং এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতো। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা এলাকার কেউ দেখেনি। মামলা করার পর এলাকার মানুষ জানতে পেরেছে। আমি মনে করি এটি একটি সাজানো মিথ্যা মামলা।
সুলতান সরদার বলেন, বাবুল একজন পঙ্গু মানুষ। আমার বিশ^াস হয়না বাবুল এ ধরনের কোন কাজ করতে পারে। এখন শুনি বাবুলের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা চাই এর একটা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হোক।
আমির হোসেন বলেন, ঘটনার সময় এলাকার কেউ বাবুলকে দেখেও নাই, ধরেও নাই। কিছুদিন পর শুনি বাবুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে। আসলে এটা আমার কাছে অবিশ^াস্য এবং সাজানো মনে হয়।
এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী সুমির বাড়িতে গিয়ে সুমিকে পাওয়া যায়নি। সুমির বাবা ইউনুছ ঢালীকেও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। সুমির ভাই জানান, সুমি তার শ^শুড় বাড়ি রয়েছেন।
আসামী পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. রাশেদা মির্জা বলেন, দীর্ঘদিন মামলাটি আদালতে চলমান ছিলো। পরবর্তীতে স্বক্ষগ্রহণের সময় আসামী উপস্থিত না হওয়ায় আমরা জেরা করার সুযোগ পাইনি। আসামীর অনুপস্থিতিতে আদালত যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দিয়েছেন। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাড. মির্জা হজরত আলী বলেন, আসামী জামিনে গিয়ে পলাতক ছিলো। আদালতে যখন স্বাক্ষী প্রমান শুরু হয় তখন আসামী আদালতে হাজির হননি। আসামী পলাতক থাকার কারণে জেরা করাও হয় নাই। আসামীর অনুপস্থিতিতে আদালত যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ে সন্তুষ্ট।