Tuesday 1st July 2025
Tuesday 1st July 2025

চিকিৎসক সংকটে ভেঙ্গে পড়েছে গোসাইরহাটের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে কার্যক্রম

চিকিৎসক সংকটে ভেঙ্গে পড়েছে গোসাইরহাটের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে কার্যক্রম

চিকিৎসক সংকটে গোসাইরহাট উপজেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারনে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে কার্যক্রম। নিয়ন্ত্রনের হাল পানি না পেয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। বিবিধ সংকট ও অনিয়ম থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অনিয়মের আখড়া হিসেবে অনেক আগে থেকেই পরিচিতি লাভ করেছে। তার মধ্যে জনবল সংকট নতুন আরও একটি সংকটে পরিণত হয়েছে। গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস কক্ষ থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ১৭টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এর মধ্য থেকে পদ শূণ্য রয়েছে ১০টি। নিয়ম অনুযায়ি ৭ জন চিকিৎসক পদায়ন থাকবে সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অথচ সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ছাড়া অন্য কাউকে পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনী চিকিৎসক ডা. ফাহামিদা সারমিন (জ্যাতি) স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন দিয়ে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই থেকে অদ্যবধি অনুপস্থিত রয়েছেন। জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. রুম্মানা সুলতানা পেষণে সংসদ ভবন হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারী ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী থেকে অনুপস্থিত। মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদীক) ডা. মো. মেহেদী হাসান খান মুন্সিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পেষণে কর্মরত রয়েছেন। সহকারী সার্জন ডা. রুবানা ইয়াসমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত রয়েছেন। এদের মধ্য থেকে ডা. রুম্মানা সুলতানা, ডা. মেহেদী হাসান খান ও ডা. রুবানা ইয়াসমিন গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বেতন-ভাতাদী গ্রহন করেন। ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান ও ডা. ফাহমিদা সারমিন (জ্যোতি) সেখান থেকে কোন বেতন-ভাতা গ্রহন করেন না। এমনকি তাদের কোন সন্ধানও নাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে।
বিভাবে চলছে হাসপাতাল তা দেখতে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টা থেকে হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা যায়, যক্ষা ও কুষ্ঠ বিভাগে এটিএলসিএ পদবীর রহিমা আক্তার নামে একজন মহিলা কর্মচারী রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে দেখা যায় টেকনোলজি মো. জাকির হোসেন কর্মরত রয়েছেন নিজ কার্যালয়ে। তিনি জানায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষার কীট শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত আর কোন কীট সরবরাহ করা হয়নি।
পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে গিয়ে দেখা যায় টিএফপিএ পদধারী নুরে আলম জিকু নামের এক কর্মচারীকে। তিনি জানায়, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলে রাব্বি। সে এইবার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি সেই বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই অফিসে সপ্তাহে এক-দুইবার আসে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দুই-তিন সপ্তাহে একবার অফিসে বসেন।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাফিজুর রহমান নিজ বাস ভবনে বসে প্রাইভেট রোগী দেখছিলেন। সকাল পৌনে ১০ টার দিকে অফিসে এসে সকালের নাস্তা খান। ১০ টা বাজার পরে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ইব্রাহীম খলিল অফিসে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে বহির্বিভাগের রোগীদের কাছে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। রোগীরা টিকিট হাতে চিকিৎসকের চেম্বারে ভীড় জমায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিনিধিগণ রোগীদের ঠেলে চিকিৎসকের কাছে যায়। বিভিন্ন প্রকার গিফ্ট চিকিৎসকের ব্যাগে গুজিয়ে দিয়ে কক্ষের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করেন তারা। রোগী চিকিৎসাপত্র হাতে নিয়ে ডাক্তারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলে ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিগণ রোগীকে ঘিরে ফেলে। ছবি তোলে চিকিৎসা পত্রের। চিকিৎসক তাদের কোম্পানীর ওষুধ লিখেছেন কিনা তা যাচাই করতে।
সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে হাসপাতালের পরিসংখ্যান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় পরিসংখ্যানবিদ কবির জমাদারের আসন খালি। তার অফিস সহায়ক জানায়, স্যার অসুস্থ তাই ঢাকায় গেছেন। স্যার ছুটিতে আছেন কিনা তা অফিস সহায়ক বলতে পারেনি।
হাসপাতালের অন্ত বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দা, গলি ও মেঝেতে এলোমেলো ভাবে বিছানা করে রোগীরা শুয়ে রয়েছে। অথচ বিভিন্ন বিভাগে সীট খালি পড়ে রয়েছে। রোগীদের সাথে আলাপ কালে জানায়, এখানে আলো বাতাস বেশী তাই সীটে যেতে তারা আগ্রহী নন।
হাসপাতালের অফিস সূত্রে জানা যায়, সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অফিস টাইম। এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপের মাধ্যমে হাজিরা নেয়া হয়। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হাজিরা দেয়া য়ায়। সকাল ৯টার পরে যে হাজিরা দিবে তার লেট প্রেজেন্ট হবে কিন্তু এ্যাবসেন্ট হবে না। তাই অনেকে সকাল ১০টার দিকে বায়োমেট্রিক মেশিনে হাজিরা দেন।
হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পেতে আসা রোগীরা জানায়, সকাল ১০টার পরে টিকিট কাউন্টার খোলে। টিকিট নিয়ে ডাক্তারের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে করতে ১টা বেজে গেলে আর চিকিৎসা পাওয়া যায় না। অন্যদিন আবার আসতে হয়। সকাল থেকে চিকিৎসা সেবা শুরু করলে হয়তো বিনা চিকিৎসায় রোগীদের ফিরে যেতে হতো না।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. হাফিজুর রহমান মিঞা বলেন, আরএমও আর আমি মিলে উপজেলাবাসীকে সেবা প্রদান করি। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ১৭ জন চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ রয়েছে। তার মধ্যে ১০টি পদ শূণ্য। কাগজ-কলমে ৭ জন কর্মরত থাকলেও ৮ বছর যাবত ২ জন ডাক্তারের কোন হদিস নাই। অপর তিন জন ডাক্তার পেষণে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। এ বিষয়ে প্রতিমাসে প্রতিবেদন দাখিল করছি। কোন সমাধান পাচ্ছি না। নোটিশের মাধ্যমে ওষুধ কোম্পানীর লোকদের অবগত করা হয়েছে। তবুও তারা অফিস টাইমে ঢুকে পড়ে। তাদের বেশীরভাগই স্থানীয় তাই কোন নিয়ম মানছেন না। গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষার কীট শেষ হয়েছে। বিষয়টি সিভিল সার্জনকে অবগত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কীট সরবরাহ করা হয়নি।
সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে জানা যায় সিভিল সার্জন ডা. খলিলুর রহমান মিটিং এ ঢাকায় গেছেন। পরে পরিসংখ্যানবীদ সঞ্জয় ঘোস জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় জেলায় ৪ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে দুই জনই গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছে। সদর হাসপাতাল ও জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১ জন করে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে।