
ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত, নবম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সোমবার ১৬ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯ টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী, কার্ডিয়াক জটিলতা ও নিউমোনিয়া রোগে ভুগছিলেন।
মরহুমের পুত্র কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. খালেদ শওকত আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী শরীয়তপুর-২ আসন থেকে ৬ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়েছিল, তাতে শওকত আলীকেও আসামি করা হয়। তিনি মুক্তিসংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং ৭১ ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা।
সোমবার বাদ মাগরিব তাঁর নামাজে জানাযা বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বিকাল সাড়ে ৩ টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ জাতীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। আজ (১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার) সকাল ১০ টায় সশস্ত্র বাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে মরদেহ শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া বি এল স্কুলে অবতরণ করা হবে। বেলা ১১ টায় শরীয়তপুর এবং নড়িয়ার সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নড়িয়া শহীদ মিনারে রাখা হবে মরদেহ। বাদ জোহর নড়িয়া বি এল উচ্চ বিদ্যালয়ে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী।
বর্ষিয়ান এ রাজনীতিবীদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শরীয়তপুর-২ আসনের সাংসদ পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদস্য ও শরীয়তপুর-১ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন অপু, শরীয়তপুর-৩ আসনের সাংসদ নাহিম রাজ্জাক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদার, সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে, জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান কিরণ, সাধারণ সম্পাদক সরদার একেএম নাসির উদ্দিন কালু সহ আওয়ামী লীগ, বিএনপির অংগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সকল শ্রেণি পেশার মানুষ।
কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী ১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারী নড়িয়া উপজেলার লোনসিং বাহের দীঘিরপাড় গ্রামে মুন্সী মোবারক আলী ও মালেকা বেগমের ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে, ১৯৭৮ সালে সুপ্রীমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভ করেন। এর পূর্বে ১৯৫৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে কমিশন লাভ করেন। পেশাগত দক্ষতা বিবেচনা করে তাঁকে করাচির নিকটবর্তী মালির ক্যান্টনমেন্টে অর্ডন্যান্স স্কুলের প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়।
রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান (আগরতলা মামলা ষড়যন্ত্র) মামলা সহ বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসার, সৈনিক, প্রাক্তন সৈনিক, বেসামরিক-সরকারি কর্মকর্তা ও চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সমন্বয় যে বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়েছিল, কর্নেল শওকত আলী (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) তার সদস্য ছিলেন। তিনি উক্ত মামলায় মালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৯৬৮ সালের ১০ জানুয়ারী গ্রেফতার হন। তিনি আগরতলা মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ১৯৬৮-৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রায় ১৩ মাস কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক গণ-বিস্ফোরণের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু এবং কর্নেল শওকত আলীসহ অভিযুক্তগণ ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দীশালা থেকে মুক্তিলাভ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৯ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়।
তিনি ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে রণাঙ্গনে হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের অবদান রেখেছেন। তিনি প্রথমে মাদারীপুর এলাকার কমান্ডার ছিলেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টরের কমান্ডার তথা ফরিদপুর কোম্পানীর স্টুডেন্ট কোম্পানীর কমান্ডার এবং প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুজিবনগরস্থ সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্বও পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের শত্রুদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পুনরায় অকাল অবসর দেয়া হয়। অবসরের সময় তিনি কর্ণেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে অর্ডন্যান্স সার্ভিসেসের পরিচালক (ডিওএস) ছিলেন।
অতঃপর তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ছিলেন এবং দীর্ঘদিন এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
কর্নেল শওকত আলী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল তথা বিরোধী দলের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের মে মাস থেকে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৬ মাস স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে কারাবরণ করেন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি এবং নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়াও ওই সংসদে পিটিশন কমিটি, সরকারি হিসাব কমিটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে অষ্টম সংসদে তিনি পুণরায় সদস্য নির্বাচিত হন, যেখানে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিন্ধান্ত সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নবম সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৩ সালের ২২ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আঞ্জু মোনোয়ারা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন কর্তৃক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। দেশের প্রতি তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা রিসার্চ কাউন্সিল কর্তৃক মাদার তেরেসা গোল্ডমেডেল লাভ করেন।
তিনি আগরতলা মামলার উপর বাংলায় “সত্য মামলা আগরতলা, ইংরেজীতে ‘আর্মড কোয়েস্ট ফর ইনডিপেন্ডেন্স’ এবং কারাজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কারাগারের ডায়েরী’ শীর্ষক বইয়ের লেখক। ২০১২ সালে “বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও আমার কিছু কথা। ২০১৬ সালে “গণপরিষদ থেকে নবম সংসদ” শিরোনামে আরেকটি তথ্যবহুল বই রচনা করেন।