
এসএসসি-২২ ব্যাচ বহুল আলোচিত একটি ব্যাচ, মনে করা হচ্ছিল এসএসসি-২১ মনে হয় সবচেয়ে ঘটনা বহুল ব্যাচ কিন্তু না এসএসসি-২২ ব্যাচের ঘটনাবহুল সুদীর্ঘ প্রায় পৌনী ৩ বছরের যাত্রা নানা কারনে আলোচিত।
কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় সারা বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেমে এসেছিল বিপর্যয় সে বিপর্যয় কাটিয়ে এখন বিশ্ব পরিমন্ডলে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে স্কুলে লেখাপড়ার পরিবেশ।
বৈষ্ণিক সমস্যা সমাধানে আমাদের দেশেও সকল পর্যায় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এসএসসি ও এইচএসসি ২১ ব্যাচ শুধুমাত্র মৌলিক তিনটি বিষয় মূল্যায়ন করে ফলাফল দেয়া হয়েছিল। এ বছর এসএসসি-২২ ব্যাচে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ০৯টি বিষয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রত্যাশা অনুযায়ী করোনা সংকট কাটিয়ে উঠে এ ব্যাচের সন্তোষজনক প্রস্তুতি নিয়েই ১৫ জুন থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বসার অভিলক্ষ নিয়ে এগিয়েছিল সারা দেশের ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু বাধ সাধলো সিলেট বিভাগব্যাপি বয়ে যাওয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা।
বন্যার প্রাদুর্ভাব এতটাই বিপর্যস্ত করেছে সিলেট জনপদকে যেখানে অধিকাংশ এলাকায় ৮/১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে ছিলো মানুষের বসত বাড়ি, রাস্তাঘাটসহ ফসলাদী, মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল স্কুল কলেজ গুলোতে । স্থানীয় শিক্ষা অফিসের বরাতে জানা যায় সিলেট নগরসহ জেলার ১৩ টি উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষ পানি বন্দী ছিলেন এসব এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর ৩ শতাধিক উচু ভবন এই ভয়াবহ বন্যায় আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় অনির্দিষ্টকালের জন্য এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত রাখার।
গত ১৭ জুলাই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনি এমপি সংবাদ সম্মেলন করে নতুন পরীক্ষার দিনক্ষণ ঘোষনা করেন । সে অনুযায়ী আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে পূন: নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা-২২। বন্যা পরবর্তীতে বন্যা কবলিত সিলেটের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন পাঠ্য বই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ যাত্রায় সার্বিক পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে বলে আমি মনে করি। এজন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য, তারা কি আদৌ পূর্বের ন্যায় পূর্ণপ্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যজনক ফলাফল অর্জন করতে পারবে?
বাস্তবতার প্রেক্ষিত পরীক্ষা পিছানো হলেও সমীক্ষা বলছে, এ সুযোগে বেড়েছে মেয়েদের বাল্য বিবাহের সংখ্যা । প্রবাসী অধ্যুষিত শরীয়তপুর, মাদারীপুর মিলে এ অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার ছেলেদের বিদেশ যাওয়ার প্রবনতাও বেড়েছে । “বাসস” এর দেয়া তথ্যমতে দেশে বর্তমান বাল্য বিবাহের হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে আগের তুলনায় যা ১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এ হার বর্তমান সবচেয়ে বেশি।
১৫-১৮ বছরের ছেলেদের বিদেশ যাওয়ার হারও বেড়েছে আশংকা জনক হারে। এমতাবস্তায় আশংকা করা হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার আসন থেকে একটা বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে যাওয়ার বিষয়ে।
এখন প্রশ্ন হলো এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি ?
যারাই বা পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে তাদের সাফল্য কি আগের মতই অটুট থাকবে? এসএসসি ফলাফল বিপর্যয় হবে না তো ?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুজঁতেই আমার এ লেখনি । আমি লেখনির শিরোনামেই বলেছি অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সাফল্য আসবে।
এ বিষয় আমি বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব দিব সম্মানিত অভিভাবকদের, বিশেষ করে পরীক্ষার্থীর বাবা ও মা’কে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক দোয়া অনুষ্ঠান করে প্রবেশপত্র বিতরণের মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় জানানোর পর পরীক্ষার মাত্র একদিন আগে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ সময় অনেকখানি অভিভাবকত্বের জায়গায় পিছিয়ে পড়েছে।
নিয়মিত শ্রেণিসমূহের পাঠদানের রুটিনে কোনোভাবেই এ পরীক্ষার্থীদের ক্লাসের সুযোগ দেয়া সম্ভব না। তদুপরি হাতে গোনা দেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে যাচ্ছে এসএসসি-২২ ব্যাচের পরীক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনাসহ মডেল টেষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করার। আমার প্রতিষ্ঠান মজিদ জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল এন্ড কলেজ ,শরীয়তপুর, পরীক্ষা পেছানোর খবর পাওয়ার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের গাইড শিক্ষকদের মাধ্যমে খোঁজ-খবর রাখছে। অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রাখছে এবং এই প্রচেষ্টায় আমরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছি, তবে শতভাগ শিক্ষার্থীকে পূণঃ এই শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নাই। এখন মডেল টেষ্ট পরীক্ষা চলছে ৪৪৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ জন মডেল টেষ্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না । শিক্ষার্থিদের অসুস্থতায় এ সংখ্যা শতভাগ করা সম্ভব হয় নাই।
আশপাশের বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সাথে আমি কথা বলেছি তারা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু শিক্ষার্থীদের সাড়া পাওয়া যায় নাই। অভিভাবকগণও প্রত্যাশিত সহযোগীতা করছেন না। এমতাবস্থায় গ্রামগঞ্জের অনেক প্রতিষ্ঠান মডেল টেষ্ট পরীক্ষা নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। রাজধানী শহরের নামকরা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে একটি মডেল টেষ্ট নিচ্ছেন কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে শতভাগ শিক্ষার্থী মডেল টেষ্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেনা। এমতাবস্থায় আমি মনে করি, এ সময় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমান পেক্ষাপটে এ ”দুই” এর সমন্বয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থার্ড ম্যানের ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরীক্ষা শুরু হতে এখনও আধা মাস বাকি, এমতাবস্থায় শিক্ষার্থী যদি দায়িত্ব নিয়ে পড়ার টেবিলে না বসে, অভিভাবক যদি নিজ সন্তানের প্রতি সর্বোচ্চ আন্তরিক মনোযোগ না দেন, তবে সে অভিভাবকের সন্তান এসএসসি পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল নাও পেতে পারে। এজন্য এখন আর অলসতা করার সময় নেই, আজ থেকে পরীক্ষার্থীদের অনুরোধ করবো তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎকে ভালোবাসলে পূর্বের ন্যায় রুটিন করে দৈনিক কমপক্ষে ১০/১২ ঘন্টা পড়াশোনা করো। তোমার স্কুলের তত্ত্বাবধানে মডেল টেষ্ট পরীক্ষা হলে, সে পরীক্ষায় অবশ্যই অংশগ্রহন করবে। অনেকেই বাড়িতে মডেল টেষ্ট দিতে চাও, মনে রেখো স্কুলের পরিবেশে সবার সাথে স্কুলের বেঞ্চে বসে শিক্ষকের সামনে দেয়া মডেল টেষ্ট পরীক্ষা এবং তোমার রিডিং রুমে বসে দেয়া মডেল টেষ্ট পরীক্ষার মূল্যায়ন এক নয়। আর যদি তোমার স্কুলে মডেল টেষ্টের ব্যবস্থা না থাকে, তবে তুমি নিজ দায়িত্বে অনলাইনে প্রচুর মডেল টেষ্ট প্রশ্ন পাওয়া যায় সেখান থেকে একটা মডেল প্রশ্ন ডাউনলোড করে ”মন্দের ভালো” হিসেবে সেটার উপর পরীক্ষা দিতে পারো। মনে রাখবে, মূল পরীক্ষা শুরুর পূর্বে একটা যৌক্তিক পড়াশোনা ও মডেল টেষ্ট পরীক্ষা তোমার দীর্ঘ দিনের থেমে থাকা পড়ার গতি সঞ্চার করবে। তেমনিভাবে লেখার জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দ আপনি আপনার এসএসসি পরিক্ষার্থী ছেলে বা মেয়ে সন্তানটির দায়িত্ব নিন আপনার শত ব্যস্ততার মাঝেও বাবা/মা অথবা পরিবারের দায়িত্ববান একজন তার প্রতি সার্বিক মনোযোগ দিন। অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, তাদের পরীক্ষার সময়কাল অতিরিক্ত উষ্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের পেটের অসুখে ভুগতে পারে। পরীক্ষা চলাকলীন সময়ে অভিভাবককে এ বিষয় মনোযোগী থাকতে হবে। সন্তানকে খাদ্যভ্যাস মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
পরিশেষে আমি বলবো, শত প্রতিকূলতার মধ্যে এ বছর এসএসসি ব্যাচের আমার সন্তানতুল্য প্রিয় শিক্ষার্থীরা সুস্থ থেকে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর হতে এসএসসি পরীক্ষার মূলমঞ্চে বসবে এবং সাফল্যর হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরবে, আমরা শিক্ষক ও অভিভাবকগন এ যাত্রায় তাদের সহযোদ্ধা হতে চাই।
অধ্যক্ষ: এম ফরিদ আল হোসাইন.
মজিদ জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল এন্ড কলেজ, শরীয়তপুর।