
শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ছিড়ে পড়া তাড়ে জড়িয়ে দুই হাত হারানো সেই কলেজ ছাত্র সিয়াম খানকে চাকরী দিয়েছে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। গত ৫ মে থেকে সিয়াম খানকে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। নিয়োগ পত্র পেয়ে ৬ মে থেকে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে সিয়াম।
শরীয়তপুর পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি ও সিয়ামের পরিবার সুত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের উপসী গ্রামের দরিদ্র জাহাজ শ্রমিক ফারুক খানের ছেলে সিয়াম খান (১৯)। সে নড়িয়া সরকারী কলেজের একাদশ শ্রেনীর ছাত্রাবস্থায় গত ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল উপসী গ্রামে ঝড়ে ছিড়ে পড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বৈদ্যুতিক তাড়ে তড়িতাহত হয়ে গুরুতর আহত হয় সিয়াম। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিয়ামের দুটি হাত কব্জি থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। দুর্ঘটনায় দুটি হাত হারিয়েও সিয়াম তার লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। ২০১৮ সালে সিয়াম অন্যের সাহায্য নিয়ে নড়িয়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৪.০৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
সে সময় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গাফিলতির কারণে দুই হাত হারানো সিয়ামের ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাইকোর্টে রিট করা হয়ে হাইকোর্ট সিয়ামকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডকে নির্দেশ দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড আপিল করে। বর্তমানে ওই মামলাটি আপিল বিভাগে চলমান রয়েছে।
এদিকে তড়িতাহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণকারী সিয়াম খানকে মানবিক দিক ও তার ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে একটি চাকরী দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। সিয়াম খান পল্লী বিদ্যুতের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে গত ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চাকরীর জন্য আবেদন করেন। সিয়ামের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২ মে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের ৬০৫তম সভায় মানবিক দিক বিবেচনা করে সিয়াম খানকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে অফিস সহায়ক পদে চাকুরী প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত ৮ মে’র মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিদপ্তরকে অবহিত করতে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজারকে অনুরোধ করা হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতির জেনালের ম্যানেজার সিয়াম খানকে অফিস সহায়ক পদে গত ৫ মে নিয়োগপত্র প্রদান করেন। নিয়োগপত্র পাওয়ার পরের দিন ৬ মে থেকে সিয়াম শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে অফিস সহায়ক পদে দায়িত্ব পালন করছে।
সোমবার (১৩ মে) শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে সিয়াম খানকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। অফিসের অন্যান্য লোকজন সিয়াম কাজে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করছে। সিয়ামও ঠিকঠাক মতো তার দায়িত্ব পালন করতে পারছেন।
সিয়াম বলেন, দুটি হাত হারিয়ে আমি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমি ভেবেছিলাম আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমি হাল ছাড়িনি। আমি লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। অন্যের সহযোগিতায় এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হয়েছি। বর্তমানে আমি নড়িয়া সরকারী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স-এ অধ্যায়নরত আছি। আমি একজন গরীব পরিবারের সন্তান। তাই আমাকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে চাকরী দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে আমি চাকরিটি সাদরে গ্রহণ করি। যেই পল্লী বিদ্যুতের তাড়ে আমার দুটি হাত হারিয়েছি সেই পল্লী বিদ্যুত সমিতিই আমার চাকরীর ব্যবস্থা করেছে। এই চাকরীর ফলে আমার জীবনের নিরাপত্তা অনুভব করছি। এতে আমি এবং আমার পরিবার খুবই খুশি। চাকরী দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই পল্লী বিদ্যুত সমিতিকে।
শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. সোহরাব আলী বিশ^াস বলেন, দুই হাত হারানো অসহায় সিয়ামের জন্য একটি চাকরী ব্যবস্থা করতে পেরে আমরাও খুশি। সিয়াম দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং সে একজন ভালো ও ভদ্র ছেলে। দুই হাত হারিয়েও সিয়াম অফিসের দায়িত্ব ঠিকঠাক মতো পালন করতে পারছে। অফিসের সবাই সিয়ামকে কাজে সহযোগিতা করছে। অফিসের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সিয়াম তার লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, সমিতির বেতন কাঠামো অনুযায়ী সিয়ামের মূল বেতন ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর সাথে যোগ হবে বেতনের ৪০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ১ হাজার টাকা চিকিৎসা ভাতা, বিদ্যুৎ ভাতা ৬২৪ টাকা ও ধোলাই ভাতা ৩০০ টাকা। এছাড়া বছরে দুটি বোনাস ও বৈশাখী উৎসব ভাতা দেওয়া হবে তাকে। ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরী শেষে এককালীন সিয়াম পাবে ৪০ লাখ টাকার ওপরে।