
বিজ্ঞান প্রযুক্তির বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম আলোচিত বিষয় নবায়নযোগ্য শক্তি (রিনিউয়েবল এনার্জি) বা জ্বালানি । বিশ্বের জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে তেমনি ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জনপদগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য শক্তির চাহিদাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে । শক্তির টেকসই স্তর বজায় রাখতে এবং পৃথিবী নামক গ্রহকে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর উদ্ভাবন ও এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে । তেমনি নতুন কিছু আবিষ্কার মানেই যে সংযোজন হওয়া তা নয়, কিছু বিষয় বিয়োজনও হয় । কোন ক্ষেত্রে বিয়োজন বা বিলুপ্তি চোখে দেখা যায়, আবার কিছু দেখা যায় না । আবার যেগুলো দেখা যায় না, সেগুলোর সিংহ ভাগই পরিবেশের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে । এতে আবিষ্কারের চেয়ে বেশি জরুরি, পুরাতনকে পুর্নব্যবহার বা রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নবায়ন করে কাজে লাগানো । বর্তমানে সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক এক প্রকার শক্তি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানি । নবায়নযোগ্য শক্তি হলো এমন এক শক্তির উৎস, যে শক্তি বারবার ব্যবহার করার পরও নিঃশেষ হয় না অর্থাৎ একবার ব্যবহার করার পর পুনরায় ব্যবহার করা যায় । বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎসের মধ্যে রয়েছে: সৌরশক্তি, হাইড্রো, জিয়োথারমাল, ওয়েভ এবং টাইডাল এনার্জি, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি , ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল উল্লেখযোগ্য । নবায়নযোগ্য শক্তিকে কখনো সবুজ শক্তি বা পরিষ্কার শক্তি নামেও অভিহিত করা হয় । এসব শক্তির উৎস অফুরন্ত । বর্তমান বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যাপক গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে । বর্তমানে অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়যোগ্য শক্তি ব্যবহার করেছে । নবায়নযোগ্য শক্তিসমূহ পরিবেশ বান্ধব এবং কার্বন নি:সরণ মুক্ত । জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকশই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী আন্দোলনসমূহ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উৎসাহ অব্যহত রেখেছে । বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার ।
বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিকাংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মোটরযান চলাচলে এবং বাসা বাড়ির তাপ-উৎপাদনে । বর্তমানে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য ঊৎস থেকে ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে । নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যানবাহন ব্যবস্থা এবং গ্রিন টেকনোলজি সমৃদ্ধ শক্তি সাশ্রয়ী গৃহস্থালি পণ্য প্রবর্তনে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । প্রচলিত বিদ্যুৎ সরবরাহবিহীন জায়গাগুলোতে জনসাধারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর নির্ভরশীল । এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণির নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে । বিশ্বে অন্যতম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত সব চেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে । ফলে সর্বোচ্চ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করছে । নর্ডিক দেশসমূহ নবায়নযোগ্য শক্তি বান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে । বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি গ্রহণ করেছে । এদিকে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার ও এর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি গ্রহণ করেন । এখন পর্যন্ত ১৪৪ টি দেশের নবায়নযোগ্য শক্তি নীতির নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে । জীবাশ্ম জ্বালানির সাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল পার্থক্য হল শক্তির উৎসটির নবায়নযোগ্যতা, তথা যে উৎসটি ব্যবহার করা হবে সেটি যাতে সহজে নিঃশেষ না হয়ে যায় । জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস যেমন: প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদির ব্যবহারের সাথে সাথে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায় । অনুমান করা হয় আগামী ১০০ বছর পর জীবাশ্ম জ্বালানির নি:শেষ হয়ে যাবে । অপরদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন: সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবহারের সাথে সাথে সহজে নিঃশেষ হয়ে যাবে না । টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ – স্রেডা এক্ট-২০১২ প্রনয়ন করে বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ো ফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে শনাক্ত করে এবং শক্তিগুলোর যথাযথ ব্যবহারের পরামর্শ দেন । প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় সৌরশক্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬ টি প্রতিষ্ঠান সোলার প্যানেল তৈরি করছে । বিশ্বে সৌরশক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশ । ‘রিনিউয়েবলস ২০১৭ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট’-তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে ৬০ লাখ সৌর প্যানেলের মধ্যে ৪০ লক্ষই বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে ৷ বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/ বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে । বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিকল্প হিসেবে গ্রামের অনেকে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে । বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয় । তাছাড়া ২০১৭ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া ২১১.৪৬ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুতের মধ্যে ২০১.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতই জাতীয় গ্রীডের বাইরে । এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম যার পরিমাণ প্রায় ১৭৮.৮৬ মেগাওয়াট । আরো রয়েছে প্রায় ৫০০টি সোলার পাম্প যাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৬.৪৩ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ । এছাড়া ক্লিন স্টোভ ও বায়োগ্যাস ব্যবহারেও সামনের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ ৷ দেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে । এর মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ খাতের কর্মসংস্থানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১টি দেশের মধ্যে পঞ্চম । জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রকল্প এবং ইন্টার-অ্যামেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিপি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মিনি গ্রিড ও স্ট্যান্ড অ্যালোন দুই ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে বাংলাদেশ ৷ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমানে দেশের ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসে । নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো বর্তমানে বিশ্বের বিদ্যুতের ২৬% চাহিদা পূরণ করে । তবে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) মতে ২০২৪ সালে এর শেয়ারের পরিমাণ ৩০% পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে । ধারণা করা হয়, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদন করা যাবে । ডেনমার্ক ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ ভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্বেগ ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইএএ) এর বিগত ২০১১ সালের প্রকল্প অনুসারে, সৌর শক্তি জেনারেটর ৫০ বছরের মধ্যে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে, সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বলে প্রত্যাশা করেন । তাছাড়া জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি পরীক্ষাগার অভিক্ষেপ করে, প্রকল্পগুলি যে বায়ু বিদ্যুতের স্তরিত ব্যয় ২০১২ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫% হ্রাস পাবে । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্পদ ক্ষতি না করে বর্তমান জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকেই টেকসই উন্নয়ন বলা হয় । নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো পরিবেশের উপর কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির উৎসগুলোর প্রভাব হ্রাস করা । এ ধরনের সুবজ শক্তির ব্যবহারের ফলে কেবল দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় সাশ্রয় হবে না বরং জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণের বিপদ থেকে বায়ুমণ্ডলকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস এবং জ্বালানি নিরাপত্তার প্রয়োজনে জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার হওয়া আবশ্যক; জ্বালানি সংরক্ষণ ও তার দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানির অপচয় রোধ । আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয়ের সহিত বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও সম্পদের ভিত্তি প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বিধায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণ ও সকল প্রকার সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক । প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ, ব্যবহার ও পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিজ্ঞান ভিত্তিকরণ করতে হবে । পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নবায়নযোগ্য সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে । প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমিয়ে, পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন । দূষণরোধকল্পে শূন্য নির্গমন, পানি ও প্লাস্টিকের পুর্নব্যবহার ও পুনর্চক্রায়ন ব্যবস্থা এবং বর্জ্য পরিশোধন করতে হবে । নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি সংরক্ষণ সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করতে হবে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেক্টোনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । এছাড়া স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণ ও প্রয়োগের বিষয়ে বাস্তবসম্মত শিক্ষাদান প্রয়োজন । নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রধান নির্ভরতা করতে প্রয়োজন প্রযুক্তি । তাহলেই জীবাশ্ম জ্বালানির এই কুফল থেকে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে সুন্দর এবং কার্বন মুক্ত বসুন্ধরা উপহার দিতে পারব ।
লেখক: মো. তোফাজ্জল হোসেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক রুদ্রবার্ত