
বাল্যবিবাহ একটি মারাত্নক সামাজিক ব্যাধি। রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ একটি বড় ধরণের অন্তরায়। ইউনেস্কোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৯%, যা সারা বিশ্বের মধ্যে চতুর্থতম। বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দরিদ্রতা, সুশিক্ষার অভাব, অসচেতনতা ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রথাকে। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফলে অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারে কন্যাসন্তানকে এখানো বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি তারা উপলব্ধি করতে পারেনা যে, বাল্যবিবাহের ফলে সন্তান ধারণ ও প্রসবের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়। মায়ের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে তার সন্তানের জীবনে। বেড়ে যায় শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার। এভাবে একটি জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
প্রমত্তা পদ্মার তীরবর্তী নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপ লীলাভূমি শরীয়তপুর । দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে শরীয়তপুরবাসীর অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। এ জেলার অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষি ও মৎস্য নির্ভর। জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রবাসে বসবাস করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শরীয়তপুর জেলার ধারাবাহিক অগ্রগতি তাৎপর্যপূর্ণ হলেও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসের ফলে শরীয়তপুর জেলায় বাল্যবিবাহের দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় যথেষ্ট প্রকট। অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের বয়স ১৫ পার হতেই কিংবা তার পূর্বে বিয়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়। বাল্যবিবাহের ফলে অনেক কিশোর-কিশোরীর সম্ভাবনাময় জীবন অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়।
শরীয়তপুর জেলাকে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে জেলা প্রশাসন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এজন্য জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্কুল ও কলেজসমূহে গঠন করা হয়েছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ টিম। মসজিদের ইমাম ও মন্দিরের পুরোহিতদের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সুশীলসমাজ, শিক্ষকবৃন্দ ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আয়োজন করা হচ্ছে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিষয়ক বিভিন্ন সভা ও সেমিনার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের কল্যাণে তথ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। জেলার সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে প্রয়োজনীয় দিক-নিদের্শনা প্রদান করা হচ্ছে। আইনজীবি, নোটারি পাবলিক, নিকাহ্ রেজিস্ট্রার ও পুরোহিতদের সমন্বয়ে বাল্যবিবাহ নিরোধের ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ ও এ সংক্রান্ত সহায়তা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ হতে পুরোপুরি নির্মুল হবে বাংলাদেশ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, শরীয়তপুর সদা তৎপর। জেলা প্রশাসনের এ প্রচেষ্টার কাক্সিক্ষত সাফল্য লাভে প্রয়োজন অধিক জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা। সুশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মেয়েরা বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে- এ উপলব্ধি সকলের মাঝে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সুশিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে ছেলে-মেয়ে উভয়কে অমিত সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের আশা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাল্যবিবাহ নির্মুল করা সম্ভব। সুশিক্ষার মাধ্যমে গড়ে উঠবে প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীর দুরন্ত শৈশব, নির্মুল হবে বাল্যবিবাহের অভিশাপ।
লেখক: কাজী আবু তাহের, জেলা প্রশাসক, শরীয়তপুর