Tuesday 1st July 2025
Tuesday 1st July 2025

আর কোন শম্পা যেন বাল্য বিবাহের শিকার না হয়

আর কোন শম্পা যেন বাল্য বিবাহের শিকার না হয়

শম্পা একটি মেয়ের নাম। শম্পা একটি কলির নাম। শম্পা একটি বালিকার নাম। শম্পা কলি একদিন ফুল হবে, ফুল থেকে ফল হবে, পত্র পল্লবে ভরে উঠবে শম্পার জীবন। সে লেখা-পড়া শিখবে, মানুষের মত মানুষ হবে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের পায়ে দাড়াবে এমনটিই প্রত্যাশা শম্পার। বিয়ে কী, জীবন কী, যৌবন কী এখনো জানে না শম্পা। সবে মাত্র পঞ্চম শ্রেনিতে উঠেছে শম্পা। এ সময়ে এ বয়সে কী-ই-বা জানার আছে কী-ই-বা বুঝার আছে। কোন কিছু জানা বুঝার দরকারই বা কী ? খাবে, পড়বে, ঘুমাবে এইতো তার জীবন। এখন সময় তার ঘাস ফড়িং ধরার, এখন সময় তার প্রজাপতি দেখে অবাক হওয়ার, এখন সময় তার বন্ধুদের সাথে চড়–ইভাতি খেলার। পুতুল সাজানো, পুতির মালা দিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়ে অনাবিল উচ্ছাসে, অনিন্দ আনন্দে দিন কেঁটে যায় শম্পার। এমন নান্দনিক ক্ষণ জীবন থেকে হারিয়ে যাবে তা হয় না। তবুও মধু পূর্ণিমার জোসনা ঝরা মায়াবী চাঁদে রাহুর গ্রাস। এ যেন দুধমাখা ভাতে ঘি। শম্পা শুনতেছে তার বিয়ে। এতটুকু অনুভব অনুভুতি নেই। এতটুকু অনুরাগ শিহরণ নেই। এ এগার বছর বয়সে কোন কিছু বুঝে উঠার সময় সুযোগ চিন্তা-চেতনা না থাকারই কথা। যেমনটি নেই মোতালেবেরও। সেও বুঝতে শিখেনি এ পৃথিবী মহত্ব। মাত্র বারো বছর বয়স। এ বয়সে মোতালেব কাজী দোকানের কর্মচারী। এরই নাম নিয়তি। কবি সুকান্ত এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করবে নবজাতকের এ অঙ্গীকার করেছিল। কবি সুকান্তের পৃথিবী কী বাসযোগ্য হয়েছে ? তাই যদি হতো মোতালেব কাজীকে দোকানের কর্মচারী হতে হতো না। মোতালেবের যে বয়সে বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে থাকার কথা ছিল সে বয়সে মোতালেব দোকানের কর্মচারী। ভাগ্যাহত মোতালেবের ভাগ্যে না জুটলো লেখা পড়া, না জুটলো খেলাধুলা। ঘুড়ি উড়ানো, পাখির বাসার সন্ধান, নদীতে ডুবসাঁতার করা মোতালেবের হলো না। এ দিক দিয়ে শম্পা কিছুটা ভাগ্যবান। কারণ শম্পা পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ছে। সে যাই হোক বয়সের দিক দিয়ে দু’জনেই সমবয়সী। জীবন নামের নৌকায় দু’জনেই নবীন। দুজনেই ফুড়ি। কিন্তু কেন শম্পা আর মোতালেবের ভাগ্যাকাশে মেঘের ঘনঘটা ? কেন তাদের বিয়ের আয়োজন? এর জবাব সমাজ কি দিতে পারবে? সমাজের কাছে এর জবাব খুঁজবার প্রয়োজনও নেই। যে সমাজ দুটি অবোধ শিশুর বিয়ের আয়োজন করতে পারে সে সমাজের কাছে চাওয়ার কী-ই-বা থাকতে পারে! সুতরাং করুনা চাইনা, প্রতিকার চাই। প্রতিকার চাওয়ার অধিকার দেশের নাগরিক হিসেবে সবারই রয়েছে। এছাড়া আর কী-বা চাইতে পারি! যে সমাজ শম্পার মত ১১ বছরের একটি মেয়ে মোতালেবের মত ১২ বছরের ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে পারে সে সমাজের নিকট নতুন করে আর চাওয়ার কিছু নেই।
ধিক্কার জানাই, নিন্দা জানাই। ধিক্কার নিন্দা শুধু সমাজের প্রতি নয়, ধিক্কার নিন্দা শম্পা ও মোতালেবের পরিবারের প্রতি। নিশ্চয় শম্পা এবং মোতালেবের অভিভাবক পাষন্ড। তারা মানুষ রূপী পশু। কোন মানুষের মাধ্যমে এ হেন গৃহীত কাজ সম্ভব নয়। কেবল পশুরাই এটা করতে পারে। শম্পা ও মোতালেবের বাল্য বিবাহের ঘটনা অতি সম্প্রতি দৈনিক রুদ্রবার্তা পত্রিকায় ছাঁপা হয়েছে। খবরে প্রকাশ শরীয়তপুর সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়–য়া ছাত্রী শম্পা (১১) ও একটি দোকানের কর্মচারী মোতালেব ১২ এর বিবাহের প্রস্তুতি অতি সংগোপনে নেয়া হয়েছিল। বিষয়টি এক পর্যায়ে জানাজানি হয়ে যায়। জানানো হয় শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের কে। তার নির্দেশনায় শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাহাবুর রহমান শেখের তাৎক্ষনিক ব্যবস্থায় শম্পা ও মোতালেব বাল্য বিবাহের কবল থেকে মুক্তি পায়। এখন কথা হলো কে আয়োজন করলো কিভাবে করলো এ বাল্যবিবাহের আয়োজন তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিয়েতে উকিল লাগে, উভয় পক্ষের স্বাক্ষী লাগে, বিবাহ রেজিস্টার লাগে। কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। আইনের আওতায় আনা দরকার শম্পা ও মোতালেবের অভিভাবকদেরকেও। তা করতে না পারলে বাল্য বিবাহ চলতেই থাকবে। শরীয়তপুর সহ দেশে প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিদিনই বাল্যবিবাহ হচ্ছে। যার খবর প্রশাসন পাচ্ছেন না। দু’একটি বিচ্ছিন্ন খবর মাত্র প্রশাসনের কানে আসছে। ভিতরের খবর ভয়াবহ। নানাভাবে, নানা কায়দায়, অতিসংগোপনে এ বাল্যবিবাহের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। বাল্য বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে কাজীগণ কায়দা-কানুন সৃষ্টি করছেন। কখনো নোটারী পাবলিকের দেয়া হলফনামার দোহাই দিয়ে, কখন বা সংশোধিত জন্ম নিবন্ধের দোহাই দিয়ে, কখনোবা প্রভাবশালীদের দোহাই দিয়ে কখনোবা জাল কাগজপত্র সৃজন করে কাজীগণ বাল্যবিবাহ রেজিস্ট্রেশন করে তা বৈধ করে দিচ্ছেন। বাল্যবিবাহের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত থাকলেও মূল দায়িত্ব পালন করছেন কাজী। কাজী যদি কোন বাল্য বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করেন তা হলে পৃথিবীর কারো পক্ষেই বাল্য বিবাহ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। জেলা প্রশাসনিক কিংবা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট বাল্য বিবাহের কয়টা সংবাদই বা আসে। সংবাদ পেলেতো তারা ব্যবস্থা নিবে। সংবাদ তো আর সব সময় সৃষ্টি হয় না। অতি গোপনে নির্জন বাল্য বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চান না। কোন মতে সবার চোখে ধুলো দিয়ে বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারলেই কেল্লা ফতে। আর এখানেই বড় বাঁধা বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে। কারন বিয়ের আগে খবর পেলে ব্যবস্থা নেয় হয়। বিয়ের পর খবর পেলে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যার কারণে বাল্য বিবাহ সম্পন্ন করে সবাই পাড় পেয়ে যাচ্ছেন। বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে হলে কোন অবস্থাতেই বাল্য বিবাহকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। কেউ যদি বাল্য বিবাহের পিড়িতে বসে কিংবা বাল্য বিবাহ করে বা কোথাও যদি বাল্য বিবাহ হয় খবর পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিক ভাবে তা প্রতিহত করতে হবে। শুধু প্রতিহতই না এর সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। আর বাল্য বিবাহ যখনই হোক তা অবৈধ ঘোষণা করা দরকার। বিয়ের আগে বা বিয়ের পরে যে অবস্থায়ই বাল্যবিবাহের খবর আসুক তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক সময় বিয়ে শেষ হবার পরে বাল্যবিবাহের খবর পেয়ে নানাবিধ কারণে প্রশাসন নিরব থাকে। এটা যেন না হয়। মোট কথা যে কোন অবস্থায়, যে কোন পরিস্থিতিতে বাল্য বিবাহ ধরা পড়–ক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাল্য বিবাহ করে কেউ যদি সংসার গড়ে আর পরিনত বয়সে গিয়ে তা যদি ধরা পড়ে তা হলে তাৎক্ষনিক ভাবে সে বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করে ব্যবস্থা নিতে পারলে চিরতরে বাল্য বিবাহ বিলুপ্ত হবে। প্রয়োজনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবাহের তারিখ কাবিননামা সংযুক্ত করার নিয়ম চালু করতে হবে। যেমন চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে পদোন্নতি কিংবা অবসরের সময় কাবিননামা জমা নিয়ে হিসাব করে দেখতে হবে যে, বাল্যবিবাহের সঙ্গে কেউ জড়িত কী-না। কাউকে পাওয়া গেলে তার সুবিধা কর্তনের ব্যবস্থা নিলে অনেকাংশে বাল্যবিবাহ কমে যাবে। বিভিন্ন লাইসেন্স প্রদান, বিদেশ গমনের ক্ষেত্রেও এ প্রথা চালু করা যেতে পারে। বিবাহের পূর্বে প্রশাসনের সার্টিফিকেট প্রদর্শনের ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে। এসব করতে পারলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে না। এমনিতেই তা বন্ধ হয়ে যাবে।
আর প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও তৎপর থাকতে হবে। কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ও আত্মীয়করণের কারণে কেউ বাল্যবিবাহের উপর হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছেন না। বাল্য বিবাহ নিরোধে একমাত্র নির্ভর যোগ্য ভরসা প্রশাসন। খবর পাওয়া মাত্র শরীয়তপুরে জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের যদি তৎপরতা না দেখাতেন, তিনি যদি উদাসীনতা দেখাতেন তা হলে শম্পা-মোতালেব বাল্য বিবাহের করাল গ্রাস থেকে কোন ভাবেই রক্ষা পেত না। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাহাবুর রহমান শেখ যদি সরেজমিনে ব্যবস্থা না নিত তাহলে সবার চোখ এড়িয়ে গোপনে বাল্য বিয়েটি হয়ে যেত। এজন্য শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের ও শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুর রহমান শেখ কে ধন্যবাদ প্রদান না করলে অকৃতজ্ঞ মনে হবে। ধন্যবাদ জেলা প্রশাসক মহোদয়, ধন্যবাদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আপনাদেরকে।
বিশেষ করে জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের কে স্যালুট করতে হয় তার বাল্য বিবাহ বিরোধী নানা কাজকর্ম ও মনোভাবের জন্য। ইতোমধ্যেই তিনি শরীয়তপুর জেলায় বাল্যবিবাহ বিরোধী আশা জাগানিয়ে স্বপ্নের অবতারনা করেছেন। তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে অচিরেই শরীয়তপুর জেলা বাল্যবিবাহমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দৈনিক রুদ্রবার্তা পত্রিকার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক কে সাধুবাদ জানাচ্ছি। দৈনিক রুদ্রবার্তা সবসময় মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত সংবাদকে গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন। শুধু একজন শম্পা বা মোতালেবে নয় বাল্য বিবাহের হুমকীতে নিপতিত সকল শম্পা ও মোতালেবের পাশে দৈনিক রুদ্রবার্তা ছিল, আছে এবং থাকবে।
লেখক: শহীদুল ইসলাম পাইলট, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।