সোমবার, ৫ই জুন, ২০২৩ ইং, ২২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৬ই জিলক্বদ, ১৪৪৪ হিজরী
সোমবার, ৫ই জুন, ২০২৩ ইং

পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে শরীয়তপুর জেলা

পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে শরীয়তপুর জেলা

মাদারীপুর জেলার পূর্বাংশের ৬টি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে শরীয়তপুর জেলা। ফরায়েজী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে এই জেলার নামকরন করা হয় শরীয়তপুর। ১৯৬৩ সালে মাদারীপুরের পূর্বাংশের ৫টি থানা নিয়ে ঢাকাতে ‘পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে আলাদা মহকুমা দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালে জাতির জণক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫টি থানা নিয়ে মহকুমা করার অনুমোদন দেন। কিন্তুু নতুন মহকুমার সদরদপ্তর সরকারীভাবে ঘোষণা দেওয়ার পূর্বেই কুচক্রীমহল কর্তৃক বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন। পরবর্তীতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে একটি সাইট সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে পালং থানাকে সদর দপ্তর করে উক্ত থানার সাথে জাজিরাকে যোগ করে ১৯৭৭ সালে ৪ঠা নভেম্বর শরীয়তপুর মহকুমা উদ্ধোধন করা হয়। এরপর জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৪ সালের ৭ই জুন শরীয়তপুর জেলায় পরিনত হয়।
শরীয়তপুর জেলার আয়তন ১১৭৭.১১ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ। জেলার উত্তরে মুন্সিগঞ্জ, দক্ষিণে বরিশাল, পূর্বে চাঁদপুর ও পশ্চিমে মাদারীপুর জেলা। নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা, গোসাইরহাট, পালং (শরিয়তপুর সদর) ও জাজিরা এই ৬টি উপজেলা নিয়ে শরীয়তপুর জেলা। অবশ্য ইতিমধ্যে ভেদরগঞ্জ উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে সখিপুর থানা নামে একটি নতুন থানা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক কার্যক্রম ক্ষমতা এখনও না পাওয়ায় ভেদরগঞ্জ প্রশাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জেলার শিক্ষার হার প্রায় ৫০ শতাংশ। নবগঠিত মহকুমা সৃষ্টির প্রারম্ভে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। রাস্তাঘাট বলতে কিছুই ছিলনা বর্ষার সময় নৌকায় আর শীতের সময় পায়ে হেটে ছাড়া যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ক্ষেতের উপরের আইল দিয়ে পায়ে হেটে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হতো। খাল-বিল-নদীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। নদীতে পানি ছিল ভরপুর, আজ যে সকল এলাকা নিয়ে সখিপুর থানা হয়েছে ঐ অঞ্চলের বেশির ভাগ ছিল মেঘনা নদীর অংশ। ইলিশ মাছের ছড়াছড়ি ছিল প্রচুর। তা ছাড়া মেঘনার পাড়ে বালুচর, কোদলপুর, পট্টি, পদ্মার পাড়, সুরেশ্বর, ওয়াবদা, পালেরচর। র্কীতিনাশার পাড়, আঙ্গরিয়া এবং আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়, খাসেরহাট, মাদারীপুরের নদীগুলো থেকে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা হত এবং ঐ সব স্থানগুলো ছিল ইলিশ মাছ বিক্রির ব্যবসার আড়ৎ। আজ আর সেই ইলিশ মাছও নেই নদীও নেই। যতটুকু নদী আছে তা চর পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় এলাকাটি ছিল চরাঞ্চল।
আমাদের মহকুমা শহর ছিল মাদারীপুর এবং জেলা ছিল ফরিদপুর। ওখানে যেতে হলে পায়ে হেটে আঙ্গারিয়া গিয়ে ষ্টিমারে মাদারীপুর থেকে অন্র একটি ষ্টীমারে গোয়ালন্দ হয়ে ফরিদপুর যেতে হতো। অবশ্য তখন গয়না নৌকার প্রচলন ছিল। ঢাকা শহরে যেতে হলে গোয়ালন্দ হতে ষ্টীমারে চর মুগরিয়া মাদারীপুর, আঙ্গারিয়া, কোটাপাড়া, সুরেশ্বর, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ পৌঁছাতে হতো এবং বরিশাল থেকে ষ্টিমারে পট্টি, ডামুড্যা, চাঁদপুর মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঢাকার বাদামতলী পৌঁছাতে হতো। ১৯৫৪ সালের পর ক্রমান্বয়ে লঞ্চ সার্ভিস চালু হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল ছিল মেট্রিক পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল জেলা শহর ফরিদপুর এবং আমাদের নিকটবর্তী জেলা শহর বরিশালে। আমি কনেশ্বর হাইস্কুল থেকে জলপথে যাতায়াতের সুবধা ছিল বিধায় মেট্রিক পরীক্ষা দেই বরিশাল শহরের এ কে স্কুলে। ওই সময় আমাদের অঞ্চলে কোন কলেজ ছিল না। ১৯৬৯ সালে প্রথম ডামুড্যাতে পূর্ব মাদারীপুর কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। শরীয়তপুরের বাদ বাকি কলেজগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতার পর। পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ছিল অপ্রতুল। আইউব এর আমলে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও মহকুমা শহর মাদারীপুর এবং এর আশপাশেই সীমাবদ্ধ ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় আইন শৃঙ্খলার অবস্থা তত উন্নত ছিল না। এক কথায় আড়িয়াল খাঁ নদীর উত্তর-পূর্বাংশের থানাগুলো পদ্মা-মেঘনা নদীর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় যোগাযোগবিহীন একটি অনুন্নত অবহেলিত দুর্গম এলাকায় আমরা বসবাস করতাম।
১৯৫৪ সাল থেকে আমি ঢাকা শহরে বসবাস করি প্রথমে ঢাকা ওয়ারী এলাকার যোগীনগরে। পরে ১৯৬০ সালে টিকাটুলি এলাকার ১৩/১/সি, কে এম দাশ লেনে জায়গা ক্রয় করে প্রথমে টিনসেড পরে ছোট একটি বিল্ডিং করে বসবাস করে আসছি। তখন ঢাকা শহর বেশি বড় ছিল না। আইউবের আমল থেকে ঢাকা শহর উত্তর-পূর্ব পশ্চিম দিকে প্রসারিত হতে থাকে। স্বাধীনতার পর ক্রমান্বয়ে শহরটি বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত হয়ে মহানগরে পরিণত হয়। প্রথম অবস্থায় ঢাকাতে আমাদের অঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকজন লোক বাস করতেন, এর মধ্যে উচ্চপদস্থ অফিসারের সংখ্যা ছিল আমার জানা মতে ৮/৯ জন। তারা হলেন নড়িয়া, নিবাসী মরহুম এফ এইচ খান ওরফে বাবু খান, মরহুম ড: আবদুল হক ফরিদী, মরহুম আমির হোসেন, মরহুম নুরজ্জামান, ডামুড্যা থানা নিবাসী মরহুম খোদা বক্স, গোসাইরহাট নিবাসী বাবু যুগেশ চন্দ্র ঘোষ, পালং থানা নিবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম হায়দার খান। ঢাকাতে ‘ফরিদপুর মজলিশ’ নামে একটি জেলা সমিতি ছিল। উক্ত সমিতির সভাপতি ছিলেন মরহুম বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম। গোপালগঞ্জের সায়েদুর রহমান নামে এক ব্যাক্তি ছিলেন সাধারন সম্পাদক। আমি ১৯৬০ সালে উক্ত সমিতির কার্যকারি পরিষদের একজন সদস্য ছিলাম। ১৯৬২ সালে উক্ত সমিতির দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচনে আমরা পূর্ব মাদারীপুরের লোকেরা ডামুড্যা নিবাসী ইষ্টার্ণ ফেডারেল ইনসুরেন্স কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার খোদাবক্স সাহেবকে দিয়ে সভাপতি পদে মনোনয়ন পত্র জমা দেই। অন্যদিকে তৎকালীন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি ফরিদপুরের ইসমাইল সাহেবও সভাপতি পদে মনোনয়ন পত্র জমা দেন। ভোটার সংখ্যা ছিল মাদারীপুর মহকুমায় অনেক বেশি। তদুপরি মাদারীপুরের ভোটাররা পূর্ব মাদারীপুরের খোদবক্স সাহেবকে ভোট না দিয়ে ইসমাইল সাহেবকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেন এবং এখান থেকে মাদারীপুরের পূর্বাংশে লোকদের মধ্যে পশ্চিমাংশের লোকদের প্রতি একটি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই মাদারীপুরের পূর্বাংশের লোকদের মধ্যে একটি আলাদা মহকুমা করার চিন্তা জাগ্রত হয়। তখন আমি এবং ভেদরগঞ্জ থানার নারায়ণপুর নিবাসী আর্টিষ্ট কুদ্দুস একত্রে ঢাকায় অবস্থানরত ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, পালং, জাজিরা ও গোসাইরহাট থানার ভাইদের বাসায় গিয়ে গিয়ে পূর্ব মাদরীপুরের লোকদের নিয়ে একটি আলাদা সংগঠনের সমর্থন যোগাতে থাকলাম। এত যথেষ্ট সাড়াও পেলাম।
অবশেষে ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে নাড়িয়া থানার কাঠহুগলি গ্রামের মরহুম এস, এম, কে জয়নাল আবেদিন সাহেব কর্তৃক ভাড়া করা ঢাকা ষ্টেডিয়ামের পূর্বাংশের একটি সেমিপাকা দোকান ঘর প্রাঙ্গনে তৎকালীন ভেদরগঞ্জ থানার নান্দ্রা গ্রামের মরহুম আকা মোহাম্মদ আবদুল গনি মাষ্টারকে আগে থেকে তার গ্রামের বাড়ি হতে ঢাকায় এনে পূর্বে মাদারীপুরের ঢাকা প্রবাসী লোকদের এক সমাবেশে জনাব গনি মাষ্টারের সভাপতিত্বে ‘পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতি’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সভায় ডামুড্যা নিবাসী খোদাবক্স সভাপতি ও নড়িয়া নিবাসী এস এম কে জয়নাল আবেদিনকে সাধারন সম্পাদক ও আমাকে কোষাধ্যক্ষ করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়।
এই সমিতির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে এলাকার উন্নতিসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম এবং প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে পূর্ব মাদারীপুরের যথা: ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, গোসাইরহাট, পালং, জাজিরা থানা নিয়ে একটি আলাদা মহকুমা গঠন করার আন্দোলন গড়ে তোলা। পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির কার্যকারী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যাদের অগ্রণী ভূমিকা এবং যথেষ্ট ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে আমরা একটি আলাদা মহকুমা এবং পরে জেলা পেয়েছি। ঐসব সম্মানিত ব্যাক্তিদের নাম ও ঠিকানা এখানে তুলে ধরলাম।
১. গোসাইরহাট থানাঃ শামসুর রহমান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ সুগার এন্ড ফুড কর্পোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান, জহিরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ আবুজর গিফারী কলেজ, একে এম খলিলুর রহমান, এডভোকেট ঢাকা সুপ্রিম কোর্ট, ডাঃ এস এ করিম, বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক ও চাকরিজীবী।
২. ডামুড্যা থানাঃ খোদাবক্স হাওলাদার (জীবন বিমা), ইন্সুরেন্স কোম্পানীর জনক, সরদার মহীউদ্দিন, জীবন বীমা, এবিএম আবুল হাশেম, আলী আশ্রাব, এডভোকেট, ঢাকা হাই কোর্ট, মাকসুদুর রহমান, জীবন বীমা বর্তমানে নিউইয়র্ক এ, সামসুর রহমান সিকদার, জীবন বীমা।
৩. ভেদরগঞ্জ থানাঃ মোঃ আজিজুল হক মল্লিক, আব্দুল কুদ্দুস রাঢ়ী (আর্টিষ্ট), আব্দুর রশিদ মুন্সি, বিশিষ্ট লঞ্চ ব্যবসায়ী, আব্দুল হামিদ, জীবন বীমা, আব্দুর রহমান বকাউল, এডভোকেট লুৎফুর রহমান সরদার, প্রফেসর ডাঃ আব্দুর সোবহান।
৪. নড়িয়া থানাঃ চরাত্রা নিবাসী আব্দুল কাদের ঢালী, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ডাইরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর ডেপুটি ডাইরেক্টর, আবুল হাশেম, এডভোকেট অবসরপ্রাপ্ত এডিসি, ভোজেশ্বরের প্রাক্তন এমপি- ডাঃ আবুল কাশেম সাহেবের ছোট ভাই, এস এম কে জয়নুল আবেদীন, (কাঠহুগলি), জুলফিকার আলী হাওলাদার (ঘড়িসার), ফজলুল হক সিকদার, সাবেক ডিজিএম জনতা ব্যাংক লিঃ, মুন্সী আব্দুর রশীদ, ব্যবসায়ী (নলতা)।
৫. জাজিরা থানা ঃ সফর আলী মল্লিক, কোলকাতা থেকে আগত চাকরিজীবি, গিয়াস উদ্দীন মোল্লা, কোলকাতা থেকে আগত একজন চাকরিজীবি, গোফরান মল্লিক, এককালীন লঞ্চ ব্যবসায়ী, সামসুল হক, শাখা প্রধান, শিক্ষা অধিদপ্তর, আবদুল জলিল মাল, চাকরিজীবি। আজিজ সিকদার (পাট পরিদপ্তর) অফিসার, আব্দুল হাসেম মাল (শাখা প্রধান সড়ক ও জনপথ)।
৬. পালং থানা ঃ আনসার উদ্দীন আহমেদ, রুদ্রকর, মুন্সি আব্দুল হান্নান, বুড়িরহাট, আব্দুর রসিদ, ব্যাংক ম্যানেজার, দাসার্তা, ডাঃ মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, বুড়ির হাট, বাবু প্রফুল্ল কুমার রায়, সাংবাদিক।
পূর্ব মাদারীপুর সমিতি গঠিত হওয়ার পর আমরা আমাদের পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে সমিতির কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকি। যথাসময়ে ১৯৬৪ সালে আমরা ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে উক্ত পাঁচ থানা নিয়ে একটি আলাদা মহকুমা গঠন করার জন্য একটি প্রতিবেদন দাখিল করি। ইতিমধ্যে ১৯৬৫ সালে ডিসেম্বর মাসে পুনরায় কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনে সমিতিতে কিছু নতুন মুখের আবির্ভাব হয়। এরা হলেন এডভোকেট আবিদুর রেজা খান প্রাক্তন এম,এন,এ, ভেদরগঞ্জের ছয়গাও ইউনিয়নের লাকার্তা নিবাসী জনাব আমিনুর রহমান সিকদার ওরফে চুন্নু মিয়া এবং নড়িয়া থানা কার্তিকপুর নিবাসী জনাব সামিউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী। ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে খোদাবক্স সাহেব সভাপতি, নড়িয়া (ভোজেশ্বর) নিবাসী আবুল হাসেম, এডভোকেট পরে এডিসি সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে কোষাধ্যক্ষ করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৬৭ সালের নির্বাচনে খোদাবক্স সভাপতি, আবিদুর রেজা খান সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে পুনরায় কোষাধ্যক্ষ করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এবারকার কমিটিতে আমিনুর রহমান সিকদারকে সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। অবশ্য সমিতির সভাপতি জনাব খোদাবক্স সাহেব অফিসিয়াল কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকায় বেশীর ভাগ সময় আমিনুর রহমান সিকদার সাহেব সভাপতির কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন। সমিতির সৃষ্টিলগ্ন থেকে আমার ১৩/১/সি, কে এম দাস লেনস্থ বাসার ঠিকানায় সমিতির কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলাম। পরে জনাব আবিদুর রেজা খান সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তার এলিফ্যান্ট রোডস্থ বাসার ঠিকানায় সমিতির অফিসিয়াল কার্যক্রম চালাই।
পূর্ব মাদারীপুর সমিতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আপদে-বিপদে দুস্থ মানবতার সেবায় আমরা আমাদের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করে আসছি বিধায় এলাকাবাসী সমিতির কার্যক্রমের প্রতি যথেষ্ট খুশী ছিল। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ জাজিরাতে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। জীবন্ত মানুষকে গাছের ডালে আটকে রাখা। অনেক জায়গায় মাটিতে পোতা টিউবওয়েল উপড়ে ফেলেছিল। বিশেষ করে নড়িয়া থানায় জানমালের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশী।
এ বিভীষিকাময় খবর ঢাকাতে পৌছামাত্র পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আমাকে গ্রুপ লিডার করে জরুরী ভিত্তিতে রিলিফ সামগ্রী নিয়ে দূর্গত মানুষদের উদ্ধার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য এলাকায় পাঠানো হয়। আমার সাথে ছিলেন সামিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (পিংকু মিয়া), আবদুল কুদ্দুস রাঢ়ীসহ আরো অনেকে। আমরা দুর্গত এলাকায় পৌছে প্রথম ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও জাজিরা থানায় ৩টি রিলিফ ক্যাম্প স্থাপন করে দূর্গতদের মাঝে রিলিফ সামগ্রী বিতরণ করি। আহতদের চিকিৎসার জন্য ভেদরগঞ্জ, তেলিপাড়া নতুন হাটে, নড়িয়া ও জাজিরায় জরুরী ভিত্তিতে সরকার ভ্রাম্যমান হাসপাতাল খোলে। সমিতির পক্ষ থেকে আমরা হাসপাতালে জরুরী ভিত্তিতে প্রচুর ওষুধ, তুলা, ব্যান্ডেজ, গজ, পাউরুটি, বিস্কুট সরবরাহ করি, এসব ত্রাণসামগ্রী ঢাকা থেকে সমিতির সদস্যরা সংগ্রহ করে প্রায় প্রতিদিনই লঞ্চে ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, জাজিরা রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে পাঠাতে থাকে। আর আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব ত্রাণসামগ্রী দুর্গতদের মাঝে বিতরণ করেছি। কোনো কোনো জায়গায় সরকারি ত্রাণের চেয়ে সমিতি বেশি ত্রাণ বিতরণ করেছে। পরে ওষুধ, শাড়ি, লুঙ্গী, গেঞ্জি, কম্বল, দুধ, চাল বিতরণ ছাড়াও সমিতির উদ্যোগে ৩৪টি নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুতে দেয়া হয়। তৎকালীন ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার, কুমিল্লার এডিসি এবং ঢাকা হতে বিভিন্ন অফিসার, ডাক্তার, নার্স সার্বক্ষণিক ভাবে ভ্রাম্যমান হাসপাতাল ও রিলিফ বিতরণ তদারকিতে এসেছিলেন। দূর্গত মানুষের সেবা করতে যেয়ে মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এস এম হাফিজ পুরাতন টিনের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন, এক পর্যায়ে টিটোনাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঢাকা বিভাগের কমিশনার কমপক্ষে ৮ বার এলাকা সফর করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খানও দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। প্রায় দুই মাস পর্যন্ত পূর্ব মাদারীপুরে জনকল্যাণ সমিতির ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক তিন থানায় রিলিফ অপারেশন চালিয়েছে।
সমিতির রিলিফ বিতরণের কার্যক্রম ধরন দেখে সরকারি অফিসাররা অত্যন্ত মুগ্ধ হন। ডিসি সামাদ সাহেব মাঝে-মধ্যে সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সাথে সমিতির ত্রাণসামগ্রী সমন্বয় করার নির্দেশ দিতেন। দিনভর বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে রিলিফ বিতরণের কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো। প্রায় রাতেই ডিসি সাহেব আমাদের চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন। একদিন ডিসি সাহেব আমাদের চা খাওয়ার জন্য তার পিওনকে পাঠালেন তখন আমি, সামিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং কুদ্দুস রাঢ়ী ডিসি সাহেবের ওখানে চা খেতে গিয়ে দেখি ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার হাসানুজ্জামান চৌধুরী ডিসি সাহেবের ক্যাম্পে বসা। ডিসি সামাদ সাহেব আমাদের সমিতির রিলিফ অপারেশনের প্রশংসা করে কমিশনারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। কমিশনারও আমাদের ত্রাণ বিতরণের প্রশংসা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের সমিতির নাম মাদারীপুর না রেখে পূর্ব মাদারীপুর রাখলেন কেন? জবাবে আমি বললাম স্যার, মাদারীপুর মহকুমার সদর দপ্তরের পূর্বাংশে, ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, গোসাইরহাট, পালং ও জাজিরা থানাগুলো নিয়ে আমরা আমাদের সমিতির নাম “পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতি রেখেছি”।
মাদারীপুরের সাথে এ থানাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত করুণ। পায়ে হেঁটে ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যম নেই, তাছাড়া আড়িয়াল খাঁ আমাদের পৃথক করে রেখেছে। স্যার, পূর্ব মাদারীপুরের ৫টি থানা নিয়ে একটি মহকুমা দাবীই এর মূল উদ্দেশ্য। আমরা এ ব্যাপারে সমিতির পক্ষ থেকে ১৯৬৪ সালে আপনার দপ্তরে আলাদা মহকুমার দাবি জানিয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এমন সময় ডিসি সাহেব কমিশনারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্যার এলাকায় রাস্তা-ঘাট নেই বললেই চলে। আবাদ করা জমির উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে ভ্রাম্যমান হাসপাতালগুলোর তদারকি করছি। রাস্তা-ঘাট থাকলে অপারেশন কাজ আরো বেগবান হতো। কমিশার সাহেব আমাদের বললেন, আপনারা ঢাকাতে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, ডিসি সামাদ সাহেবকে বললেন, আমি এ ব্যাপারে আপনার মতামত চেয়ে পত্র দিলে, আপনি বিস্তারিত বিবরণ জানাবেন, এরপর থেকে আমরা মাঝে মধ্যে কমিশনার সাহেবের অফিসে খবর নিতাম। অবশ্য তখনকার দিনে কমিশনার অফিসে যোগাযোগ করা সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগরের তৎকালীন এম এন এ জনাব এন এ লস্কর সাহেব আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। ঐ সময় ঢাকা-ভেদরগঞ্জ রুটে লস্কর সাহেবের দুইটি লঞ্চ চলাচল করতো। এর তদারকি করতেন নারায়নপুর নিবাসী আবদুর রশিদ মুন্সি। লস্কর সাহেবের অফিস ছিল পল্টনে। রশিদ সাহেব পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন তার মাধ্যমে লস্কর সাহেবের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। তিনি আমাদের নিয়ে কয়েকবার কমিশনারের অফিসে গিয়ে মহকুমার ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন। এ জন্য মরহুম লস্কর সাহেবের প্রতি আমরা অনেক ঋণী।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নতুন মহকুমা অনুমোদন:
১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৭২, ৭৩ ও ৭৪ সালে সরকার দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। ১৯৭৫ সনের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাকশাল চালু করেন এবং আবদুর রাজ্জাক বাকশালের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ৬২টি মহকুমাকে জেলায় পরিণত করেন। প্রত্যেক মহকুমা/জেলায় একজন করে গভর্ণর নিয়োগ দেয়া হয়। আবিদুর রেজা খান পূর্ব মাদারীপুর সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং একজন এম,এন,এ ও জেলা গর্ভণর হওয়ায় আব্দুর রাজ্জাক এবং আবিদুর রেজা খানকে পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতি পক্ষ হইতে ঢাকাস্থ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনষ্টিটিউট মিলনায়তনে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্য, ৬২ জন জেলা গভর্ণর ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সভায় মন্ত্রী পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং মুন্সীগঞ্জের গভর্ণর জনাব কোরবান আলীসহ কয়েকজন গভর্ণরদের পক্ষ থেকেও আলাদা মহকুমা দাবির প্রতি সমর্থন জানানো হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমি সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কিছুদিন পর আমরা জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরের পূর্বাংশের ৫টি থানা নিয়ে আলাদা মহকুমা করার অনুমোদন দিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা পূর্ব মাদারীপুর জনকল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে পূর্বে বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে যে প্রতিবেদনটি দাখিল করেছিলাম সেখানে ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, গোসাইরহাট, পালং ও জাজিরা থানা নিয়ে মহকুমা করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট থানা হতে ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে ডামুড্যা থানা গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার ডামুড্যাসহ ৬টি থানার মধ্যে জাজিরাকে বাদ দিয়ে বাকি ৫টি থানা নিয়ে আলাদা মহকুমার অনুমোদন দেন। কিন্তু সদর দপ্তর কোথায় তার কোনো উল্লেখ ছিল না।
বঙ্গবন্ধু নতুন মহকুমার সদরদপ্তর ঘোষণা দেওয়ার পূর্বেই নিহত হন:
নতুন মহকুমা অনুমোদন হওয়ার পর আবদুর রাজ্জাক, আবিদুর রেজা খান, লাকার্তা নিবাসী চুন্নু মিয়া, সামিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, কবির শিকদার, আবদুর রশিদ মুন্সি, আমিসহ আরো কয়েকজন বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানোর জন্য বাকশাল অফিসে যাই। তখন বঙ্গবন্ধু আবদুর রাজ্জাককে উদ্দেশ্য করে বলেন, মহকুমাতো অনুমোদন দিলাম কিন্তু নতুন মহকুমার সদর দপ্তর কোথায় করবি? রাজ্জাক সাহেব বললেন, আপনি তো আমাদের এলাকা সবই চিনেন, আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই হবে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, রাজ্জাক, ফাতেমা জিন্নার ইলেকশনের সময় ঐ যে একটা বিরাট দিঘী তুমি দেখাইলা ওখানে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ছিল মেলা হতো, পাঠা বলি হতো, ওখানকার হিন্দুরা প্রায় নাকি ভারতে চলে গেছে। ওখানেতো অনেক পরিত্যাক্ত বাড়ি জায়গা রয়েছে। ওখানে সদর দপ্তর হলে মধ্যখানে হয়। রাজ্জাক সাহেব বললেন, ঐ জায়গার নাম মহিশার ডিগাম্বরী খোলা। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ওখানে সদর দপ্তর করো। সংস্থাপন বিভাগের একজন অফিসার নিয়ে জায়গাটি দেখিয়ে আন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাজ্জাক সাহেব সংস্থাপন বিভাগের একজন উপ-সচিবসহ এলাকা পরিদর্শন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মহিশারে মহকুমার সদর দপ্তর হবে এ কথা জনসম্মুখে তিনি প্রকাশ করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার নতুন মহকুমার সদর দপ্তর সরকারীভাবে ঘোষণা দেওয়ার পূর্বেই ঘটে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম নারকীয় ঘটনা। কুচক্রিমহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসলেন।
১৯৭৭ সালে মরহুম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ডামুড্যার কিছু সংখ্যক ব্যক্তি নতুন মহকুমার সদর দপ্তর ডামুড্যাতে করার জন্য তৎকালীন সরকারের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। উহারই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ঢাকা ডিভিশনের কমিশনার ফরিদপুরের ডিসির মতামত চাহিয়া পত্র দেন এবং ফরিদপুরের ডিসি আবদুল মুহিত চৌধুরী ডামুড্যাকে সদর দপ্তর করার জন্য জোরালোভাবে মতামত ব্যক্ত করেন। সরকার নতুন মহকুমার সদর দপ্তর ডামুড্যাতে করার জন্য কেবিনেট এর মিটিং কল করেন। এদিকে নতুন মহকুমার সদর দপ্তর এক কর্ণারে ডামুড্যাতে হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া, পালং থানার জনগণ লাকার্তা নিবাসী মশিয়ুর রহমান সিকদার সাহেবের ঢাকার ওয়ারীর বাসায় এক সভা করেন। উক্ত সভায় ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও পালং থানার বহু গন্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাহারা সকলেই নতুন মহকুমার সদর দপ্তর মহকুমার এক কোনে ডামুড্যাতে হওয়ার বিরোধিতা করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে “মহিশারে” নতুন মহকুমার সদর দপ্তর করার জন্য সবাই এক মত পোষণ করেন। ঐ সভায় কর্ণেল শওকত আলী, আবেদুর রেজা খান, সামিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, চামটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন, পালং এর নাসিরুদ্দিন কালু বক্তব্য রাখেন। রাজ্জাক সাহেব তখন কুমিল্লা জেলে ছিলেন, আমি গোপনে তাহার মতামত জানতে চাইলে সে বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত স্থান মহিশার ছাড়া অন্য কোথাও সমর্থন দিবেন না।
এদিকে উক্ত তিন থানার বুদ্ধিজীবি, পদস্ত সরকারী অফিসার ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীগণ মহিশারের পক্ষে সরকারের নিকট প্রতিবেদন এবং টেলিগ্রাম পাঠান। ইহাছাড়া ভেদরগঞ্জ, নড়িয়া ও পালং থানার সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ আলাদা একটি প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করে মহিশারে সদর দপ্তর করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দাখিল করেন, তৎকালীন সরকারের উপদেষ্টা ফরিদপুর নিবাসী আকবর কবির সাহেব কার্তিকপুরের ছামিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে পিংকু মিয়ার আত্মীয় থাকার সুবাদে চৌধুরী সাহেব এবং আমি আকবর কবির সাহেবের বাসায় গিয়ে নতুন মহকুমার সদর দপ্তর প্রসঙ্গে সমস্ত বিষয় তাকে অবহিত করি। উহারই পরিপ্রেক্ষিতে আকবর কবির সাহেব নির্ধারিত কেবিনেট মিটিং বন্ধ করিয়া এলাকা পরিদর্শন করেন এবং ডামুড্যার নেতৃবৃন্দকে মহিশারে সদর দপ্তর করার সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ রাখেন। তাহারা মহিশারে সদর দপ্তর করার বিরোধিতা করেন। অবশেষে সরকার বাধ্য হয়ে সংস্থাপন বিভাগের সচিব আবদুর রহিম সাহেবকে চেয়ারম্যান করে ৮ সদস্যের একটি সাইট সিলেকশন কমিটি গঠন করেন। উক্ত সাইট সিলেকশন কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন” এলজিআরডি ও কো-অপারেটিভ মন্ত্রণালয়ের যুক্ত সচিব মো: ইয়াহিয়া, পিডব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী, রোড এন্ড হাইওয়ের প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ বিভাগের ডিআইজি, সংস্থাপন বিভাগের একজন প্রধান প্রকৌশলী, সংস্থাপন বিভাগের একজন উপ সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার।
১৯৭৭ সালের ১০ জুন থেকে ১২ জুন পর্যন্ত সাইট সিলেকশন কমিটির সদস্যরা প্রত্যেক থানা হেড কোয়ার্টার পরিদর্শন করেন এবং উপস্থিত লোকদের কাছে জানতে চান সদর দপ্তর কোথায় হলে ভালো হয়। নতুন মহকুমার নামকরণ সম্পর্কেও জানতে চান। নড়িয়া ও পালং থানার লোকেরা পূর্বে মহিশারের কথা বললেও সাইট সিলেকশন কমিটির পরিদর্শনকালীন সময়ে যার যার থানার কথা সে সে বললো। দেখা গেছে নড়িয়া থানার জনাব সামিউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন চামটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব আমীর হোসেন মহিশারের পক্ষে কমিটির নিকট মতামত ব্যক্ত করেন। কিছুদিন পর জানতে পারলাম সাইট সিলেকশন কমিটি পূর্বের ৫টি থানার সাথে জাজিরা থানাকে যোগ করে পালং থানার সদর দপ্তরকে মহকুমা সদর দপ্তর হিসেবে নির্ধারণ করে সরকারের নিকট তাদের রিপোর্ট পেশ করেন, এখানে উল্লেখ্য যে মহকুমা নামকারণ ‘শরীয়তপুর’ সম্পর্কে আমাদের এলাকার কোনো লোকেরই কোন অবদান নেই। সাইট সিলেকশন কমিটির ১নং সদস্য ইয়াহিয়া সাহেব এর সাথে পূর্ব হতেই অনুমোদিত মহকুমার লোকেরা তার সাথে দেখা করতে গেলে একটা কথা বলে দিতেন। আমরা পরিদর্শনে গেলে আপনারা আপনাদের মহকুমার নাম আপনাদের অঞ্চলে জন্মেছেন কামেল পীর নেতা শরীয়ত উল্যার নামানুসারে শরীয়তপুর নামকরণের কথা বলবেন এবং প্রত্যেক থানার লোকেরা সেইভাবে বলেছেন, এ সময় শরীয়তপুরের শীর্ষস্থানীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক রাজবন্দী হিসেবে কুমিল্লা কারাগারে ছিলেন।
অবশেষে ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর পূর্ব মাদারীপুরের ৬ থানাকে নিয়ে নবগঠিত শরীয়তপুর মহকুমার উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্টের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আবদুল মোমেন খান। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সংস্থাপন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান। পরে ১৯৮৪ সালে ৭ জুন প্রেসিডেন্ট এরশাদ এর আমলে নবগঠিত মহকুমা জেলায় পরিণত হয়।
প্রথমে নবগঠিত মহকুমা ৭ বৎসরের মাথায় নতুন জেলা হিসেবে পরিণত হওয়ায় এবং তৎকালীন সরকারগুলি নবগঠিত জেলাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে উন্নিত করার দিকে নজর না দেওয়ায় আমরা ১৯৮৫ সাল হইতে ৯২ সাল পর্যন্ত জনাব সামিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী এবং ৯২ সাল হইতে ৯৬ সাল পর্যন্ত জাজিড়া নিবাসী প্রাক্তন এম.পি জনাব আমিনুল ইসলাম দানেশ সাহেব সভাপতি এবং আমি পুরু ১১ বৎসর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে “শরীয়তপুর জেলা উন্নয়ন সমিতি” নামে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে শরীয়তপুরকে একটি পূর্নাঙ্গ জেলায় রূপান্তরীত করার লক্ষে প্রায় ১১ বৎসর চেষ্টা তদবির চালিয়ে যেতে থাকি অবশেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসায় দেশরতœ জনাবা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় এবং জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক পূর্ণ মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পাওয়ায় তার নেতৃত্বে তৎকালীন সংসদ সদস্য জনাব কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী ও মাষ্টার মুজিবুর রহমান কে নিয়ে মরণের আগ পর্যন্ত শরীয়তপুরকে একটি পূর্নাঙ্গ জেলায় রূপান্তরীত করার লক্ষ্যে সাধ্যমত চেষ্টা তদবির চালিয়ে গেছেন যার দরুন শরীয়তপুরের জনগণ রাজ্জাক সাহেবকে শরীয়তপুরের “রূপকার” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে জেলা বইমেলা, ৯৭ কর্তৃপক্ষ জাতীয় গ্রন্থদিবস ও জাতীয় গ্রন্থ সপ্তাহ উপলক্ষে ০৭/০১/৯৭ তারিখে আমার বিগত দিনের নানাবিধ সামাজিক কর্মকান্ডের উজ্জলতার স্বাক্ষর স্বরূপ জেলার শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক হিসেবে আমাকে গুনীজন সংবর্ধনা প্রদান করেন। শরীয়তপুর বইমেলা উপলক্ষে স্থানীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে এক সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোঃ আঃ রহমান অনুষ্ঠিত সভায় শরীয়তপুর সরকারী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও বইমেলা আহ্বায়ক মোঃ সিরাজুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সভাপতি আঃ রব মুন্সী, সুপ্রিম কোর্টের এড্ভোকেট সুলতান মাহমুদ সিমন, সাংবাদিক অনল কুমার দে, ভেদরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান রাড়ী, শরীয়তপুর সরকারী কলেজের ভি.পি দেলোয়ার হোসেন।
মাননীয় পাঠকবৃন্দ, আপনারা শরীয়তপুরবাসী আমাকে সংবর্ধনা প্রদান করায় আমি আপনারদের নিকট চিরকৃতজ্ঞ। আমার বয়স এখন ৯১ বৎসর চলছে। দোয়া করি শরীয়তপুরবাসীর মনবাঞ্ছনা করুনাময় আল্লাহ তা’য়ালা পূর্ন করুক এবং যার দৌলতে আমরা শরীয়তপুর জেলা পেয়েছি সেই মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কবরের আজাব মাফসহ তাহাকে বেহেশ্ত নসিব করুন এবং আমাকেও আপনারা দোয়া করবেন, যেন আমি আমান-ঈমান নিয়ে মরতে পারি।

মোঃ আজিজুল হক মল্লিক (আজিজ মল্লিক)
উপদেষ্টা, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ

সরকার কর্তৃক স্বীকৃত “গুনীজন”


error: Content is protected !!