
কোচিং সেন্টার থেকে গড়ে উঠেছিল একটি বেসরকারি স্কুল। স্কুল প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন আওয়ামী যুবলীগ নেতা নাঈমুল হাসানসহ ৬ জন ব্যক্তি। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাঈমুল হাসান ২০২১ সালে শাহ আলম, মনোয়ার ও আনোয়ারকে জোর পূর্বক স্কুলটি থেকে বের করে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে শাহ আলম, মনোয়ার ও আনোয়ার স্কুলে গেলে তাদেরকে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় নাঈম হাসান। ওই মামলায় তিন শিক্ষক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
সম্প্রতি এমন ঘটনা আলোচনায় এসেছে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার প্রতিভা সাইন্স প্রিপারেটরি স্কুলকে কেন্দ্র করে।
স্কুলের বিভিন্ন নথিপত্র, মামলার এজহার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভেদরগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম হাসানের ভাই শাহিনুল ইসলাম ১৯৯৪ সালে প্রতিভা কোচিং সেন্টার নামে একটি কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে শাহিনুল ইসলাম কোচিং সেন্টারের দায়িত্ব নাঈম হাসানকে বুঝিয়ে দিয়ে ইতালি চলে যান। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে শাহিনুল ইসলাম দেশে ফিরে এসে কোচিং সেন্টারটিকে স্কুলে রূপান্তর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্কুলের জমি, ভবনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ মেটাতে শাহিনুল ইসলামসহ তার ভাই নাঈমুল ইসলাম, আরিফুল ইসলাম ও শাহ আলম হাওলাদার, আনোয়ার হোসাইন, মনোয়ার হোসাইন নামে ৬ জন ব্যক্তি সমান মালিকানায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে বেশ ভালোভাবেই সুনামের সঙ্গে চলছিল বেরসরকারি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু ২০২১ সালে আওয়ামী যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম হাসান দলীয় প্রভাব বিস্তার করে জোর পূর্বক শাহ আলম হাওলাদার, আনোয়ার হোসাইন ও মনোয়ার হোসাই কে স্কুল থেকে বের করে দেয়। এরপর থেকে তারা তিনজন শত চেষ্টা করেও আর স্কুলের মালিকানা ফেরত পাননি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে আত্মগোপনে চলে যান যুবলীগ নেতা নাঈম হাসান। এরপর গত ৩ মার্চ ভূক্তভোগী তিন মালিক ওই স্কুলে গেলে আত্মগোপনে থাকা নাঈম হাসানের মোবাইল ফোনের পরামর্শে স্কুলের সহকারী শিক্ষক স্বর্ণা আক্তার জাতীয় জরুরী সেবার নম্বরে ফোন করে জানান যে, স্কুল ভাঙচুর করতে এসেছে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পরে ভেদরগঞ্জ থানা পুলিশ স্কুল থেকে ওই তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
ভূক্তভোগী তিন মালিককে থানায় নেওয়ার পরে যুবলীগ নেতা নাঈম হাসান স্কুলের সকল শিক্ষককে সাক্ষী রেখে সহকারী শিক্ষক স্বর্ণা আক্তারকে ওই তিন মালিকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু স্বর্ণা আক্তারসহ অন্যান্য শিক্ষকরা চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করতে রাজি হোননি। এমন পরিস্থিতিতে নাঈম হাসান স্কুলের আয়া মাকসুদা বেগমকে সহকারী শিক্ষক পরিচয় দিয়ে থানায় চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করান। পরে ওই মামলায় শাহ আলম হাওলাদার, আনোয়ার হোসাইন, মনোয়ার হোসাইন গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। বর্তমানে তারা তিনজনই জেল হাজতে রয়েছেন।
অন্যদিকে গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শরীয়তপুরের আহ্বায়ক ইমরান আল নাজিরসহ অন্যান্যরা গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে স্বৈরাচার সরকারের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে শরীয়তপুর শহর থেকে নাঈম হাসানকে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ জানিয়েছে, নাঈম হাসানকে অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নামে জুলাই আন্দোলনে হামলার অভিযোগে মামলা ছিল।
নাঈম হাসান গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ভূক্তোভোগী তিন মালিকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করা মাকসুদা বেগমও পালাতক রয়েছেন। এরপর থেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন চাঁদাবাজি মামলার সাক্ষী স্কুলের শিক্ষক নাজমিন জাহান নিপা, শাহনাজ ইসলাম, জান্নাতুল ফেরদৌসসহ অন্যান্যরা। তারা জানিয়েছেন, ভূক্তোভোগী ওই তিন মালিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তারা ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সুন্দর ব্যবহারের অধিকারী। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলায় আমাদেরকে সাক্ষী করা হয়েছে। এতদিন যুবলীগ নেতা নাঈম হাসানের ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি। তিনি বাইরে থাকলে হয়ত চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষী প্রদান করাতো।
দীর্ঘদিন যাবত স্কুলের মালিকানা হারানো, রাজনৈতিক কারণে কোণঠাসা হয়ে থাকা ভূক্তভোগী শাহ আলম হাওলাদার, আনোয়ার হোসাইন, মনোয়ার হোসাইন বর্তমানে মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলায় কারাগারে থাকায় তাদের পরিবার নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও প্রভাবশালী অঢেল টাকার মালিক নাঈম হাসানের কবল থেকে ভূক্তোভোগীরা কারামুক্ত হবেন কি না, সেই চিন্তা এখন পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও স্থানীয় সচেতন মহলের।
স্কুলটির প্রাক্তন শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম দৈনিক রুদ্রবার্তাকে বলেন, আমি ২০১৮ সালে ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন থেকেই আমি জানতাম স্কুলের মালিক স্যারেরা ছয়জন। সালে শাহ আলম, মনোয়ার ও আনোয়ার স্যার খুব ভালো শিক্ষক। তাদের কাছে আমি পড়াশোনা করেছি। তারা চাঁদাবাজির মত জঘন্য কাজ করবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আমি চাই বিষয়টি নিয়ে সঠিক তদন্ত করা হোক।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া দৈনিক রুদ্রবার্তাকে বলেন, ওইদিন স্যাররা এসেছিলো তাদের ন্যায্য দাবী আদায় করতে। কিন্তু নাঈমুল হাসান স্যার পালিয়ে থেকে স্কুলের আয়াকে দিয়ে স্যারদের মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সামনে আমাদের পরিক্ষা আমাদের রেজাল্ট খারাপ হলে এদায় কে নেবে? আমাদের স্যারদের আমরা চিনি তারা কখনোই এই কাজের সাথে জড়িত নয়। নাঈমুল হাসান স্যার একাই স্কুলের মালিকানা নেওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে স্যারদের জেলে রেখেছেন। আমরা নাঈমুল হাসানের বিচার চাই।
এবিষয়ে মামলার স্বাক্ষী ওই স্কুলের শিক্ষিকা স্বর্না আক্তার দৈনিক রুদ্রবার্তাকে বলেন, ঘটনার দিন আমরা ক্লাসে ছিলাম হঠাৎ করে দেখি শাহ আলম, মনোয়ার ও আনোয়ার স্যার কিছু লোক নিয়ে আমাদের স্কুলে এসেছেন। পরে বিষয়টি নাঈমুল হাসান স্যারকে জানালে তিনি ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিতে বলে। আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানালে তারা এসে তাদের আটক করে নিয়ে যায়। পরে নাঈমুল হাসান স্যার আমাদের ফোন দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করতে বলে। আমি মিথ্যা মামলা করতে রাজি না হলে নাঈমুল স্যার আমাদের স্কুলের আয়া মাকসুদা খালাকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দেওয়ায়। আমি প্রতিবাদ করলে নাঈমুল হাসান স্যার সহ আমাদের স্কুলের সকল শিক্ষকদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
আটক মনোয়ার মাষ্টারের স্ত্রী শারমিন রুবি দৈনিক রুদ্রবার্তাকে বলেন, আমার স্বামী মনোয়ার, শাহ আলম স্যার, আনোয়ার সয়ার ও যুবলীগ নেতা নাঈম ও তার দুই ভাই, এ ছয়জন মিলে তৈরি করে ভেদরগঞ্জ প্রতিভা এসপিএস স্কুল। নাঈম স্যার ও তাঁর দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আমার স্বামী মনোয়ার ও শাহ আলম স্যার ও আনোয়ার স্যারকে স্কুল থেকে বের করে দেন। আ.লীগের পতন হলে আমার স্বামী ও বাকি দুই শেয়ার হোল্ডার মিলে গত ৩ মার্চ সকালে প্রতিষ্ঠানে গেলে পলাতক যুবলীগ নেতা তাঁর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ করে পুলিশের ধরিয়ে দেয়। একজন মালিক তাঁর অধিকার বুঝে নিতে গেছে এটা কি তার অপরাধ? একজন শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানে যাবে চাঁদাবাজি করতে এটাতো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। আমার ছেলেকে পেটে নিয়ে বাজার করে সংসার চালিয়েছিলাম কারণ আমার স্বামী রাতদিন ঐ স্কুল তৈরি জন্য শ্রম দিয়েছে। আজ ঐ স্কুলই তার জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে। এতটুকু বাচ্চাকে কি ভাবে বলবো যে, তোমার বাবা মিথ্যা মামলায় জেলখানায় বন্দি। আমার একমাসের শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি টাকার জন্য কারন আমার কাছে কোন টাকা নেই কি ভাবে আইনি লড়াই করবো।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত নাঈমুল হাসান জেলে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া যায় নি।
বিষয়টি নিয়ে মামলার বাদী ও স্কুলটির আয়া মাকসুদা বেগমের সাথে যোগাযোগ করতে তার বাড়ীতে গেলে তাকে পাওয়া যায় নি। তার মোবাইল ফোনে ফোন করা হলে তিনি মামলার বিষয় কথা বলতে চান না বলে ফোনটি কেটে দেন।
এ বিষয়ে ভেদরগঞ্জ থানার ওসি মো. পারভেজ হাসান সেলিম দৈনিক রুদ্রবার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ৩ জনকে আটক করা হয়। পরে থানায় হওয়া মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রমাণিত না হলে আমরা সঠিক রিপোর্ট তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রেরন করবো।